“জানেন তো, ‘পিকু’ ছবির শ্যুটিং করবার কালে বিগ বি (অমিতাভ বচ্চন) পাঁচ তারকা হোটেল ভুলে এই কলকাতার রাস্তায় স্ট্রীট ফুড খেতে বেরিয়েছিলেন…”
ট্যাক্সির স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে নিতে নিতে কথাগুলো বলছিল আমাদের ড্রাইভার নারায়ন দা৷ কথাটা শুনে সেসময়ে খানিক চমকেই উঠেছিলাম। সবিস্ময়টা মুখ ছিটকে বেরিয়ে পড়া শব্দগুচ্ছ পাকড়ে নিয়ে ওরা ঝরে পড়ল অচিরেই।
“তাই নাকি? বল কী?” লুকিং মিররের অতটুকু দর্পনেও আমার বিশাল আকৃতির হাঁ- খানা বেশ করে সেঁটে গেল। টুপ করে ওটাকে গিলে নিলেও বিষয়টা নারায়নদার সতর্ক নজর এড়াল না। পোক্ত চালক বলে কথা! খানিক রাশভারী হাসি হেসে বলে
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। তবে আর বলছি কী? এই না হল কলকাতার টেস্ট। এখানকার অলিতে গলিতে ছুটে বেড়ানো হাওয়ায় স্বাদের মাতোয়ারা ছুটে বেরায়।”
খানিক কাব্যিক ঢং এ মন্তব্য করে আঙুল দিয়ে স্টিয়ারিংএ ফের টকটক শব্দ তুলে নেয় নারায়ণ। আমার দৃষ্টি অবশ্য ততক্ষণে জানালা গলে বাইরে ফুরুৎ করে ডানা মেলেছে। ছোট বাতায়নের ওপারেই হুসহাস করে দৌড়ে চলছে কলকাতার ব্যস্ত সড়ক। গাড়ির ধোঁয়া, ট্রামের ঝনঝনানি, টাঙাওয়ালাদের ভেজা ঘামে পড়ন্ত বেলার বাতাসটা কেমন আদ্র হয়ে উঠেছে। দুপুরের ঝাঁঝালো রোদ কড়া শাসন করে যাচ্ছে বেশ। লম্বাটে গাছগুলোর চূড়ায় বসে সূর্যদেব বিশ্রাম পোহাচ্ছেন আয়েশ করেই। এদিকে গলাটা শুকিয়ে একদম কাঠ! সেই সকাল বেলা হোটেল থেকে কমপ্লিমেন্টারির বদৌলতে উদর পূর্তি করে বেরিয়েছিলাম। ইতিমধ্যে বেলা গড়িয়েছে। ঠাকুরবাড়ি গিয়ে রবিঠাকুরের দর্শনটা সেড়ে নেবার পর মনটা সত্যি ভীষণ ফুরফুরে লাগছিল। বিদায় কালে লাল ইটের পাঁজর চিঁড়ে বেরিয়ে আসা কোন সে কালের লুকোন দীর্ঘশ্বাস সত্যি ভীষণ ভাবুক করে তুলেছিল। মনের প্রকোষ্ঠে কেবল এক প্রতিধ্বনি বেজে উঠছিল, “আহা! জীবনটা আসলেই কতটা নশ্বর!” তবে কথায় আছে না, ক্ষিদের নাম বাবাজী! ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়! তেজস্বী কবি সুকান্ত যে কঠোর বাস্তবতা পংক্তির ছন্দে সাজিয়ে গিয়েছেন, তার ব্যবহারিক প্রমাণ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলুম বেশ। পেটমোটা হলদে ক্যাবে চড়ে এগলি সেগলি চষে বেড়াতে গিয়েই কতক্ষণ পর টের পাওয়া গেল ক্ষুধায় পেটের মাঝে মূসক মহাশয় দাবড়ে বেরাচ্ছেন। এর একটা বিহিত এবার না করলেই নয়। কিন্তু কোথায় খেলে স্বাদের ষোলআনা অসুল হবে? সেই কথাটার সুতো টেনে নিতেই নারায়নদার মুখে ভূবনজয়ী হাসির রেখ জেগে উঠল। এরপর? এরপর না হয় কথা না বাড়াই। তবে এতটুকু বলে নেই, তারপরের সময়টুকু ঐতিহ্যময় কলকাতার সব ভুলভুলাইয়া প্রতিম সড়কের মাঝে লুকিয়ে থাকা তৃপ্তির খাজানা আবিষ্কারেই কেটে গিয়েছে জব্বর। তাই শুধু কথায় চিঁড়ে না ভিজিয়ে চলুন আজ জানা যাক কলকাতার কতক মজাদার স্ট্রিট ফুডের আদ্যোপান্ত৷
বিবেকানন্দ পার্কের ফুচকাঃ
বলুন দেখি, ফুচকার স্বাদের বরাবরি করতে যায় এমন স্পর্ধা কারই বা আছে? আলু এবং তেতুল গোলা জল এই দুটোর রসায়নে হাবুডুবু খাননি এমন কী কেউ আছেন সত্যি? তবে হ্যাঁ এতটুকু হলফ করে বলতে পারি, যদি বিবেকানন্দ পার্কের এই মুচমুচে রসালো গোলা মুখে না পুরে নিয়েছেন এখন অবধি তো বেজায় ঠকে গেছেন মশাই৷ তাই ভরপাই করে নিন চটপট। আর কেবল এই পার্কেই নয় রাস্তার মোড়ে মোড়ে মিলবে ফুচকার দোকান। আর হ্যাঁ। দামটাও সেই! মাত্র ১০ টাকায় ৪ পিস!
জাইকার কাঠি রোলঃ
জানা যায়, কলকাতায় সর্বপ্রথম কাঠি রোল এনেছিল এই জাইকা। তুলতুলে রুটির বেষ্ঠনীতে রসালো পুর। উম! দেখলেই জিবে জল এসে যায়। যদি হজম শক্তি সেই পর্যায়ের হয় আর যদি নিজেকে গোপাল ভাঁড় বলে প্রমাণ করতে কোন বাজি জুড়ে নিয়েছেন তো তবে জাইকার দন্ডে ভর করে বিজয় ঝান্ডা উড়িয়ে নিতে পারবেন বিলক্ষণ। আর এর জন্য খুব বেশি একটা দূরত্ব মাপতে হবে না। কারণ, সারা শহর জুড়েই জাইকার রোলের দোকান গজিয়েছে ব্যাঙের ছাতার মত। আর এই রোলের রকমেরও বলিহারি বাবা! এগ রোল, চিকেন রোল, মাটন রোল, ভেজ রোল, পনির রোল, কাবাব রোল, ফিস রোল, আর… এই রে… মনে পড়ছে নাতো!
ফেয়ারলি প্লেসের লুচি আলুর দমঃ
কলকাতার ব্যস্ত পাড়া বলতোই ফেয়ারলি প্লেসের ছবিটা ভুস করে ভেসে উঠবে কোন সন্দেহ নেই। কর্মচাঞ্চল্য পূর্ণ এই জায়গায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সব খাবারের দোকান। জাদুকরী মসলায় মাখানো ঝালমুড়ি থেকে আরাম্ভ করে ভাত, ডাল তরকারী সব মিলে যাবে তুরান্ত। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এখানে রসনার তাজ মাথায় চেপে নিয়েছে লুচি আর আলুর দমের খুনসুটি। ভোজন বিলাস সমাপ্ত করে যখন ঢেকুর তুলতে তুলতে বিপরীতে রাস্তা মাপতে শুরু করেছি ততক্ষণে কলকাতার বুকে মনোহরী সাঁঝ কন্যা ওর ভুঙুর বাজাতে আরাম্ভ করেছে।
তিওয়ারি ব্রাদার্সের চা- সিঙ্গারাঃ
বলছিলাম, এ আবার বিশদ ব্যাখা করবার মত কোন বিষয় হলো? আরে বাপু, গরম গরম চায়ের সাথে চটকদার সিঙারা, ভাবুন তো একবার অবস্থা খানা! জি! তবে আর বলছি কী? তেকোনা পিরামিডগুলো যেন একদম স্বাদের গুপ্তধন কোন। খেয়ে শেষ করবার পরও আঙুল চেটেপুটে কূল করা যাবে না। আর যদি আমার মত চা- কফি খোর হয়ে থাকেন এরপর তাহলে তো…
কালিকার তেলে ভাজাঃ
মুচমুচে বেগুনি, তো নরম নরম আলুর চপ, কিংবা ধরুন না মোচার আপ, সঙ্গে কড়কড়ে মাছ ভাজি, ওম তোলা ডিমের চপ… ধূর ছাই লিখতে বসে এতকাল পর জিবে রস চলে এল যে। হতেই হবে। কালিকার তেলেভাজা বলে কথা৷ ওহ, হ্যাঁ। ভালো কথা জানিয়ে যাই এনাদের ঐতিহ্য কিন্তু সুদীর্ঘ ৫০ বছরের। আবার বলি, বিধান সরণির দিকে যদি কেউ পথ মাড়ান তবে ভায়া “লক্ষী নারায়ণ সাউ এন্ড সন্স” এ উঁকি মারবেন দয়া করে। তেলে ভাজাতে এনারও সুখ্যাতি আকাশছোঁয়া। শোনা যায়, এই সুস্বাদু টোপের টানে একসময় এখানে রোজ পা ফেলতেন স্বয়ং সুভাষ চন্দ্র বোস!
প্রিন্সেস ঘাটের ঘটি গরমঃ
বেশি কিছু বলব না। কেবল চোখ মুদে কল্পনা করুন, গরম চানাচুর, তাতে টুকরো করা বদরাগী পেঁয়াজের ঝাঁঝালো মেজাজ, সবুজ মরিচ কুঁচি, আবেদনময়ী স্নিগ্ধ লেবু সুন্দরীর একটু খানি নির্যাস, আর একটু নটখটে মশলা… ব্যাস!
রবীন্দ্রসদন মেট্রো গেটের বাইরের মমঃ
তিব্বতী এই খাবারটি অবশ্য স্বাস্থ্য সচেতনদের পরীক্ষায় ডিসটিংকশন সহ পাশ করে যাবে। ছোট ছোট ময়দার লেচির মাঝে সেদ্ধ তরকারি বা মাংসের পুরে ভর্তি করে জলের ভাঁপে বসিয়ে নিলেই তৈরী হয়ে যায় এই মম। না না! সেদ্ধ বলে একদম মুখ ঘুরিয়ে নেবেন না! এখানেই শেষ নয়। কারণ, এতে ঝংকার তুলে নিতে সাথে থাকে ঝাল চাটনি ও এক বাটি টুপটুপে স্যুপ।
শর্মার কচুরি জিলিপিঃ
এই যা, এটা ছাড়া তো কলকাতার গল্পটাই অসম্পূর্ণ। ছোট ছোট গরম কচুরির তরকারির সাথে গরম জিলিপি। ঝাল মিষ্টির কী অসাধারণ কম্বো মাইরি!
এছাড়াও মায়ারামস পাওভাজি আর গোলা এদের ভুলে গেলে চলবে কী করে? টাটকা পাউরুটি মাখন দিয়ে সেঁকে নানারকম তরকারিকে ছোট ছোট করে কেটে, একসাথে মিশিয়ে, বেশ করে তেল ও মশলা সহযোগে পুর মত করে শেষে ওপর থেকে একটু খানি মাখন ছড়িয়ে দিয়ে তৈরী করা হয় গোটা পদটি। আর এটিকে শতভাগ পূর্ণতা দেয় পছন্দসই সিরাপে স্নান করে নেওয়া শীতল গোলা। পাশাপাশি বর্দান মার্কেটের চিল্লা, ডাল পাকৌড়ি আর আলু টিক্কিকে উপেক্ষা করবার মত সাহস তো কোনমতেই গ্রহণ যোগ্য নয়।
আসলে কলকাতার খাঁজে খাঁজে তৃপ্তির ঢেঁকুরের রহস্য লুকিয়ে। অবাক করা বিষয়, নিউমার্কেটের বাইরে অবার্চীন বৃদ্ধের মত এক আধাখোলা দোকান মিলেছিল। মাত্র ৫০ টাকায় যে পেটপূজো সেরেছিলাম তা আজ অবধি ভুলিনি সত্যি। এছাড়াও আমিষ নিরামিষের মিলমিশের ফ্রায়েড রাইস, চাওমিন, পেস্ট্রির মিঠে কড়া স্বাদের সাথে বাদাম শরবত, বিভিন্ন ফলের জুস, বাহারি ফলার, লেবু পানি একদম শরীর মন জুড়িয়ে দেবে। তবে একটা কথা, আগেই বলেছি, বাপু আমি চা- কফি খোর। লেখক মানুষ, চায়ের লিকারের ঘ্রান মস্তিষ্কের নিউরণে কড়া না নাড়লে কলম চালানো মুশকিল হয়ে পড়ে। তাই যেখানেই যাই না কেন এই কড়া তরল আমার চাই, চা-ই। আর কলকাতায় এই কাব্যসূধাকে আবিষ্কার করেছিলাম এক অনন্য আমেজে। কেন বলছি? শুনুন তবে। জাদু নগরী কলকাতায় চা পরিবেশন করা হয় মাটির ভাঁড়ে। ব্যাপারটা একদিকে যেমন স্বাস্থ্যসম্মত অপরদিকে তেমনি নান্দনিক। আর জায়গা ভেদে এই কাপগুলোর উচ্চতাতেও রকমপের রয়েছে বৈকি! দু ইঞ্চি, দেড় ইঞ্চি, এক ইঞ্চি… আর্ট বটে!
“আমি মিঠুরাম মান্না
জামাইকা গ্রীস গিয়ে কানাডা প্যারিস গিয়ে
শিখেছি সহজ এই রান্না
হাতে নিয়ে ডেকচি
যেই তুলি হেঁচকি….”
সুধীর দাশগুপ্তের সুরে ছড়া থেকে খানিক সম্পাদনা করা গানটি ব্যবহার করা হয়েছিল সেই ১৯৭০ সালের প্রথম কদম ফুল ছবিতে। সেই সুর কী করে যেন আচানক আমার কন্ঠে ভর করে নিল। সেন্টি হয়ে গিয়েছিলাম বুঝি বেশি।
এতো গেল মশাই স্বল্প কথায় কলকাতার স্বাদের উপন্যাসের সারমর্ম। এই সারাংশ শুরু তো করা যাবে তবে শেষ করা সম্ভব হবে না কখনই। নারায়নদার নকশামত চলে ঠকিনি সেই যাত্রায় বিন্দুমাত্র। ওর ওষ্ঠ্যে ফুটে ওঠা সেই হাসি আজও মানসপটে জ্বলজ্বল করছে। সমস্ত কিছু লিখতে গেলে আস্ত এক মহাকাব্য লিখা হয়ে যাবে। তাই সব কথা না বলে কয়ে নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়ুন এই স্বাদের সমুদ্রে। বাকিটা নাহয় নিজেই মিলিয়ে নেবেন। আর হ্যাঁ। ভালো কথা। এতক্ষণ ধরে এই যে বকবক করছি তার পেছনেও একটা কারণ আছে। আরে মশাই, জগতে কারণ ছাড়া কী কোন কিছু ঘটে বলুন? তো সব কথার শেষ কথা হল এই যে, কলকাতার আবেশি মাটিতে পা রেখেছিলাম তা আজ প্রায় অনেক দিন। মাঝে কত কাল গড়িয়ে গেছে সেই গল্পগুলোকে আর ছুঁয়ে দেওয়া হয়নি। হবেই বা কী করে? এ যাবত কাল কোভিড দাদা তো খেল দেখালেন খুব। তবে হ্যাঁ। আর দেরি নয়। সেই সময় আজ আবারও এসে গেছে। জি, হ্যাঁ। আসছি প্রিয় শহর কলকাতাতে। খুব শিগগিরই। মুচমুচে ফুচকা আর মাটির ভাঁড়ের চায়ের চুমুকের সাথে আবার নতুন কোন গল্প এঁকে নিতে।
(সমাপ্ত)