আহসান মন্জিলের সুদৃশ্য হলঘরে নবাব আব্দুল গণি একাকী বসে রয়েছেন। মাথার ওপরে দুলতে থাকা মখমলের পাখার মৃদু হাওয়ার স্পর্শ খেলছে ওনার মাথায় শোভিত পারসিয়ান ঢং এর আদলে তৈরী মণি মুক্তো খচিত আভিজাত্যপূর্ণ চৌকা টুপির মাঝে গুঁজে রাখা সাদা নরম পালকটিতে। মুখে ধরে রেখেছেন সর্পিল গড়গড়ার নল। তাতে একটা দুটো টান নিয়ে খুব ধীরে ধীরে ধোঁয়া ছাড়ছেন তিনি। ওনার বুদ্ধিদীপ্ত ললাটে জেগেছে কুন্চন। তাতে চিন্তার অবয়ব স্পষ্ট। সামনের মার্বেল পাথরের টেবিলের এপর কারুকার্য খচিত গ্লাসে বাদামের শাহী শরবত রাখা রয়েছে। রোজ রাতে এক গ্লাস শরবত পান করা তাঁর অভ্যাস। কিন্তু আজ নবাব তা ছুঁয়েও দেখছেন না। মরহুম পিতা খাজা আলিমুল্লাহ পরলোকগমন করেছেন আজ মাত্র তিন বছর হতে চলল। এই ক’ বছরের মাঝেই বিচক্ষণতা আর দূর দর্শীতার জোরে কোষাগারের স্ফীতি বাড়িয়ে নিয়েছেন আরও চারগুণ। গেল মাসে কলকাতা এবং সুরাটে বিশাল জাহাজ বোঝাই করে চামড়া রপ্তানি করেছেন বিলেতে। কাঁচা চামড়া ওখানে পাকায় রূপান্তরিত হয়ে ফের ফিরবে ভারতবর্ষে। রাজ্যের বাণিজ্য ধীরে ধীরে স্বর্ণ শিখরে পৌঁছুচ্ছে। চামড়া শিল্পের সাথে পাটের ক্রমান্নতিও ধরা দিচ্ছে বেশ। দেশিয় বণিকেরা স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলতে শুরু করেছে। ক্রিমিয়ার যুদ্ধ যেন এক রকম আর্শীবাদ রূপেই ধরা দিয়েছে বাংলার জন্য। দূরদর্শি পিতা আলিমুল্লাহ তখনই এতে মাত্রা যোগ করে নিয়েছিলেন। আরমানি আর কাশ্মিরিদেরও ভিড়িয়েছিলেন একনিষ্ঠ ক্রেতা হিসেবে। পিতার সেই ধারাকে নবাব অব্যাহত রেখেছেন অত্যন্ত সফল ভাবে।
বেশ কিছুদিন আগেই বড়লাটের সাথে একটা নৈশ ভোজের আয়োজন ছিল। সিলিং এ ঝুলতে থাকা প্রকান্ড সব ঝাড় বাতির উজ্জ্বল আলোয় মেম আর সাহেবরা গোল হয়ে সব বল নৃত্য পরিবেশনে ব্যস্ত ছিল। শাহী খুশবুতে আন্দোলিত হচ্ছিল হল রুমের বাতাস। ছোট ছোট কদম ফেলে কেমন গণিতের ছকে হিসেব কষে নেবার মত নৃত্য। আনমনে দেখে যাচ্ছিলেন লাট। তবে তার চোখে মুখে ছিল উদ্বিগ্নতার স্পষ্ট কালো ছায়া। ইংরেজ শাষণের বিরুদ্ধে এখন প্রায়ই মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে ভারতবর্ষ। আজ এখানে বিদ্রোহ, কাল সেখানে বিদ্রোহ…স্বাধীনতার স্বপ্ন রেণু ছড়াতে শুরু করেছে ধীরে এই সমুদ্রের মত উত্তাল জনগোষ্ঠীর মাঝে। সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হবার পর ইংরেজরা এখন আরও অনেক সাবধান। দাবার গুটি চালার মতই ছক বেঁধে এগুতে হচ্ছে এখন। বিদ্রোহের সময় কতিপয় উগ্র সিপাহিদের পরিকল্পনা ইংরেজ সরকারের কাছে সময়মত তুলে দিয়ে এক ভবিতব্য রক্তগঙ্গার হাত থেকে রক্ষা করেছেন ঢাকাবাসীদের। তবে, মনে ক্ষীণ সন্দেহের মেঘ জমেছে ওনার। তাঁর বার্তা জনসাধারণের কাছে পৌঁছুচ্ছে তো সঠিক ভাবে? প্রশাষণিক কাঠামোতে কোন চিড় ধরল নাতো? সেটা না হলে তবে কেন কতিপয় সিপাহীদের রোষানলে পড়েছেন নবাব? প্রায় টুকরো টুকরো হুমকি উড়ে আসছে অজানা উৎস থেকে। কেউ কেউ অভিযোগ তুলছে, অপসংস্কৃতির স্রোতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন উনি। শংকার পাখি ডানা ঝাপটায় মনে। নবাব হলেও এই ভারী পোশাকের আড়ালে তিনিও একজন রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। তাঁরও পাঁজরের খাঁচার নিচে ধুকপুকিয়ে যাচ্ছে এক হৃদয়। তাতেও জন্ম নেয় উচিত অনুচিতের লড়াই। পার্থক্য শুধু এই আদালতে আসামী ও বিচারক দুই আসনেই তিনি নিজে আসীন। বড্ড কঠিণ এই লড়াইয়ে জয় ছিনিয়ে নেওয়া। এ যেন নিজের প্রতিবিম্বের সাথে যুদ্ধ করারই নামান্তর।
কিন্তু…আসলেই কি তিনি অপসংস্কৃতিতে ডুবে যাচ্ছেন? লম্বা করে গরগর শব্দ উঠে নকশা শোভিত হুক্কার উদর থেকে। মুখ থেকে একরাশ ধোঁয়া আবার ধীরে মিলিয়ে দেন বাতাসে? ওনার কপালে চিন্তার বলি রেখাগুলো ক্রমে আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে। ঘরের কোণে গোলাকার হাতির দাঁতে তৈরী টেবিলের ওপর হলুদ পাথরের ফুলদানীতে কিছু তাজা ফুল শোভা পাচ্ছে। হল ঘরের খোলা বাতায়নের ওপারেই বয়ে যাচ্ছে প্রমত্তা বুড়িগঙ্গা নদী। ওর বুকে পাঁক খেতে থাকা দামাল বাতাস হু হু করে আঁছড়ে পড়ছে ঘরের মাঝে। কতক্ষণ চোখ মুদে তা উপভোগ করে নেয় নবাব। পিতা আলিমুল্লাহ চিন্তা ক্লিষ্ট হলেই ভরা নদীর যৌবন উপভোগ করতে বের হতেন। আজ হঠাৎ পিতার অভাব অনুভূত হয় খুব।
মে মাসে মীরাটে বিদ্রোহের দাবানল ছড়ালে তার আঁচের উত্তাপ এসে লাগে এই ঢাকা তেও। উত্তেজিত হয়ে ওঠে কিছু সেপাহি। জেলা প্রশাষক জেনিংসনের বাড়িতে আশ্রিত কতক হতবিহ্ববল মহিলারা বুড়িগঙ্গার বুকে ভাসমান পাতার ওপর আরোহী পিপীলিকার ন্যায় সেদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন। কি নিদারুণ আতংকে মূহ্যমান ছিল সকলেই সেই ভয়াল ক্ষণে। কদিন ধরেই বাতাসে কর্পূরের মত কথা ভেসে বেড়াচ্ছিল, যে ব্যারাকপুর আর জলপাইগুড়ির বিদ্রোহী সেনাদের কিছু ঢাকায় এসে লালবাগের ফৌজিদের সাথে মিলে গিয়েছে। পরে অবশ্য এই গুজবেরও প্রতিহত করেছেন নবাব শক্ত হাতে। সেই উপকারের প্রতিদান দিতেও কুন্ঠিত হননি ইংরেজ সরকার। তার রাজআনুগত্যের জন্য তাঁকে অনারারি ম্যাজিষ্ট্রেট নিযুক্ত করা হয়েছে। সম্মাননটাও সেই রকম। নবাবের সালিশী রায় মানে সরকারি আদালতের রায়ের পর্যায়ে। সেই প্রাপ্তির খুশিতেই সেদিনকার সেই মনোরম সন্ধ্যার আয়োজন ছিল।
গত শীতে “কোম্পানিয়ন অব দি অর্ডার অব দি স্টার অব ইন্ডিয়া”খেতাবে ভূষিত হবার কথা ছিল ওনার। কিন্তু বিধি বাম। ওয়েলসের যুবরাজ নাকি গুরুতর পীড়িত ছিলেন তাই তার তিন দিন পর ঢাকার কমিশনার মি: এফ বি সিম্পসনের হাত থেকেই রাজকীয় পত্র আর ব্যাজ গ্রহণ করতে হয়েছিল। সেই প্রাপ্তির আনন্দ উদযাপন করতেই সরকারের সব উচ্চ পদস্থ সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তা, ইউরোপীয় সব ভদ্রলোক আর ভদ্র মহিলাদের নিয়ে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেবার। এদিকে যুবরাজের দ্রুত আরোগ্য প্রাপ্তির জন্য পন্চাশ হাজার টাকা দানের ঘোষণার সাথে সাথে সব রকমের প্রার্থণালয়ে বিশেষ প্রার্থণার ব্যবস্থাও করেছিলেন নবাব। নিন্দুকেরা সরব হয়ে উঠেছে। নানা কথা রটাচ্ছে এসবে। ফের অস্বস্তির ঘুণ পোকা সরব হয়ে ওঠে।
নাহ! আজ কেন যেন চিত্তে অস্থিরতা জেগেছে। চিন্তক্লিষ্ট নবাব দুই হাতের আঙুল ফোটান। বাম হাতের অনামিকায় শোভিত আংটির নীল পাথরটা যেন দ্যুতিময় হয়ে ওঠে আরও। ভারিক্কি ফরাসের ওপর স্বর্ণ রৌপ্য খচিত জুতার গম্ভীর আওয়াজ তুলে তিনি আনমনে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ান। ওনার শরীরে চাপিয়ে নেওয়া পাতলুনের ওপর অযথাই হাত দিয়ে কি যেন ঝেড়ে নেন। নিজের মাঝে জন্ম নেওয়া দ্বিধাটাকেই বুঝি সরিয়ে দিলেন। ওপারে বুড়িগঙ্গার বিশাল স্রোতধারা শান্ত ভাবেই বয়ে যাচ্ছে। আসমানের গায়ে কোহিনূরের মত সেঁটে থাকা চাঁদ চন্দ্রিমা বিলাচ্ছে অকাতরে। নদী বক্ষে মিটিমিটি পিদিম হাতে নিশিযাপন করে যাচ্ছে কতক নৌকারাজি। আজ নদীতে বজরা ভাসালে মন্দ হয় না। অনেক দিন হল বেগমকে নিয়ে কোন অবসর কাটানো হয়ে ওঠে না। নবাব দু হাতের ঘর্ষণে তিনবার ছন্দ তুলতেই মাথা নুয়ে নেয় আজ্ঞাবহনকারী
: বজরা উপযুক্ত করে তোল। অন্দরমহলের খাস কামরায় তলব পাঠাও। আমি বেগমের সহিত বজরা ভ্রমণ উপভোগ করতে চাই।
চুপচাপ আদেশ মেনে সরে যায় ছায়ামূর্তি। ফের নবাবের চোখ চলে যায় স্রোতবহার পানে। চুপচাপ বুড়িগঙ্গার দুধেল ফ্যানার মত স্রোত আহসান মন্জিলের পদস্নান করাচ্ছে। নীচে মশাল হাতে কিছু প্রহরীর দৌরাত্ম লক্ষ্য করা যায়। মৌণ চিন্তাক্লিষ্ট নবাব হঠাৎ উৎফুল্ল বোধ করেন। মনের কোন কোণে ঘুমিয়ে থাকা আত্মবিশ্বাসটা আবার নতুন করে জেগে ওঠে। নাহ! তিনি কোন ভুল করছেন না। স্বল্প সংখ্যক সৈন্যবাহিনী নিয়ে এতবড় উপনিবেশিক পরাশক্তির সাথে আর যাই হোক মোকাবিলা করা যায় না। ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গকে সাফল্য তরীতে এগিয়ে নিতে এখন এই ভিনদেশীদের সহায়তা প্রয়োজন। পিতা আলিমুল্লাহ চেয়েছিলেন এই বাংলা এগুবে। সমৃদ্ধ হবে। পিতার সেই স্বপ্নপূরণের জিদ চেপে বসে নবাবের শিরে। ওঁর চোখের তারায় খেলতে থাকা মশালের আলোর প্রতিচ্ছবি একদম যেন ওর স্বীয় প্রতিজ্ঞার প্রতিফলন।
বৃটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড নর্থব্রুক, বাংলার লে: গভর্নর স্যার রিচার্ড টেম্পল আজ ঢাকায় এসেছেন।আগামীকাল চাঁদনীঘাটে পানীয় জলের কলের ভিত্তি স্থাপন করা হবে। সর্বসাধারণের মাঝে বিনামূল্যে সরবরাহ করা হবে এই জল। জলবাহিত রোগের খড়্গ থেকে রক্ষা পাবে ঢাকাবাসী। এভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এগিয়ে যাবে এই বাংলা। মরহুম পিতার লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের ধারা তাঁকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবেই। সেই সাথে এর বীজ বুনে দিতে হবে তার পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে। এভাবেই তো স্বপ্নের বুনন হয়, সেটির লালন হয়। হয় বৃদ্ধি। কিন্তু তার মৃত্যু ঘটেনা কখনই। রাজনীতির খেলা হয় বাস্তবনিষ্ঠ। এখানে আবেগের কোন স্থান নেই। চুল পরিমাণ বাস্তব বিবর্জিত পদক্ষেপ একটি সুসংগঠিত অধ্যায়ের ইতি টানতে বাধ্য। ইতিহাস তার স্বাক্ষী থেকেছে বহুবার। আজ কিছুজনা হয়ত তাঁকে বুঝতে ভুল করছে। কিন্তু আগামী প্রজন্ম ঠিক বুঝে নেবে তাঁর নির্ণয় করা প্রতি পদক্ষেপের অর্থ। ইতিহাসে তাঁর মূল্যায়ন যথার্থই হবে। ভবিষ্যত প্রজন্মকে যোগ্য নেতৃত্ব দেবার উপযোগী করে তোলার দায়িত্ব বর্তমানের ওপর বর্তায়। আর সেটি তাঁকেই নিখুঁত ভাবে পালন করতে হবে। নবাবের মুখে দুশ্চিন্তার অমাবস্যার ঘোর কেটে সেখানে এখন জেগে উঠেছে সৌম্য, স্মিত হাসি। আনমনা নবাবের মনের গহীণে খেলে যায় এক নিটোল অনুভূতির ঢেউ। তিনি ভাবতে থাকেন, চারাগাছের সঠিক পরিচর্যাতেই ভবিষ্যতের বটবৃক্ষ সবল হয়ে ডাল পালা মেলে ধরে। কারণ, এক প্রজন্ম যেমন স্বপ্ন দেখে, তেমনি আরেক প্রজন্ম তাকে পূর্ণতা দেয়।