ছেলেবেলায় ঠাকুর মা’র ঝুলি পড়েন নি এমন কাউকে খুঁজে মেলা ভার। রঙ বেরঙের নানা গল্প আর কল্প কাহিনীতে ঠেঁসে থাকা ঐ দু মলাটের ঝাঁপির মাঝ থেকে পক্ষীরাজ যে কতবার ডানা মেলে শূণ্যে উড়াল দিয়েছে তার আসলেই কোন হিসেব নেই। শুধু কি তাই? ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমীর বাতলে দেওয়া পথ অনুসরণ করে অচিনদেশের অচিন কুমার ঘুমন্ত রাজকন্যাকে জাগিয়ে তুলে নেবার পর তার পানি গ্রহণ করবার জন্য দুর্বার গতিতে ছুটে চলত ঘোড়ায় চেপে বসে। এমন করে কত শত বার যে ঐ চেকনাই অশ্বের তেজী ক্ষুরের টকটক ছন্দ বাতাস ছাপিয়ে সত্যি আমাদের কানে এসে বেজেছে সেই গল্প মোড়ানো সোনালী দুপুরগুলোতে! প্রাচীন কাল হতেই রাজকীয় শৌর্য বীর্যের বাহন হিসেবে আকর্ষণীয় এই চতুষ্পদটির জুড়ি মেলা ভার।
বলছিলাম, রাজকীয় ঐতিহ্যের প্রতীক ঘোড়া গাড়ির কথা। স্প্রিং দেওয়া, ভেলভেটের গদি বসানো এই খোলামেলা এই যানটির শান, কেতাই আর জৌলুসই ছিল আলাদা। দু চাকা, চার চাকা, কখনও দুই দিকে রঙিন কাঁচের জানালা সহ আবৃত আসন, তো কখনও আবার উন্মুক্ত আসন বিশিষ্ট এই গাড়ি গুলোর চাকা ছিল বৃহৎ আকৃতির এবং মজবুত কাঠের তৈরী। ব্যবহার এবং স্থান ভেদে এর নামও ছিল হরেক রকম। কোথাও এটা “টাঙা”, কোথাও “জুড়ি গাড়ি” কিংবা কোথাও “এক্কা গাড়ি” নামে পরিচিত ছিল। এই সব গাড়ি চালকদের বলা হয় কোচয়ান বা সহিস। বিচিত্র তাদের পোশাক আশাক। ঘোড়াকে চালনা করবার সময় তাদের কন্ঠে বেজে উঠত নানা রকমের শ্লোক।
আমাদের উপমহাদেশের বর্ণাঢ্য ইতিহাসে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বিশেষ ভাবে অলংকৃত করেছে এই ঘোড়া গাড়ি। মজার ব্যাপার, আদুরে এসব ঘোড়া দ্বারা চালিত গাড়ি চলাচলের সুবিধার জন্য গোরাপত্তন ঘটে সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নের। পায়ে কুরে নাল পড়ে টকটক ছন্দে যেন তেনারা সগর্বে চলতে পারে তার জন্য প্রথমে ইট সুরকি, এরপর সিমেন্ট বালি এবং সর্বশেষে পিচ ঢালা ইট দিয়ে রাস্তা সংস্কারের ক্ষেত্রে আসে আমূল পরিবর্তন।
এখানে একটা মজার তথ্য না দিলেই নয়, ট্রাম, ফিটন বা ব্রহস গাড়ির মত এই ঘোড়া গাড়ি চালনা করবার জন্য পরবর্তীতে ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ প্রশাষণ কতৃক গৃহীত হয়েছিল “স্টেট ক্যারেজ আইন”। ঐ আইনের আওতায় যেকোন ঘোড়া গাড়িকে পরীক্ষা করবার পর তাকে লাইসেন্স দিত কলকাতা পুলিশ। ভাবা যায়! পরীক্ষা পাস করলে ঘোড়া গাড়ির সেই লাইসেন্স মিলত ৫ টাকার বিনিময়ে!
বলা বাহুল্য, ভারতবর্ষে ঘোড়া গাড়ির প্রচলন ঘটে ইংরেজ শাসন আমলে। ঢাকাতেও ঘোড়ার গাড়ির আগমন মূলত সেই সময়টাতেই। অতীতে রাজা, বাদশাহ, আমির, ওমরাহ, জমিদারেরা সব ঘোড়ার গাড়ি বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতেন। তবে, রণাঙ্গনে রসদ সরবরাহের প্রধাণ বাহন বলতে এই টমটম বা ঘোড়া গাড়ি কে বুঝাত। ঢাকার নবাব খাজা আলিমুল্লাহ আমীরানাশানে সোনা রূপা খচিত টমটমে চড়ে ভ্রমণ করতেন।
১৮৩০ সালে ঢাকায় যখন এটি চালু হয় তখন ইংরেজ শাসন জারি রয়েছে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের ‘ ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী-১’ বই থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ঢাকাতে আর্মেনীয়রা আঠার ও ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে প্রভাবশালী সম্প্রদায় ছিল। তারা তাদের ব্যবসায়িক কাজের সুবিধার জন্য তৎকালীন শাঁখারি বাজারে যেসব দোকান পাট স্থাপন করেছিল তাদের মাঝে “সিরকো এন্ড সন্স” অন্যতম ছিল; যেখানে ইউরোপ থেকে আমদানীকৃত নানা জিনিষ পাওয়া যেত। ইতিহাসে বর্ণিত রয়েছে, ১৮৫৬ সালে এই “সিরকো” প্রথম ঢাকা শহরে ঘোড়া গাড়ির প্রচলন করে। ১৮৪৪ সালে “ক্যালকাটা রিভিউ” তে উল্লেখ আছে, বিভিন্ন ধরনের ঘোড়া গাড়ির কথা। যেগুলোকে কেরাঞ্চি বা ক্রাঞ্চি গাড়ি বলা হত। এই গাড়ি গুলোকে চালনা করবার জন্য ছোট ছোট ঘোড়াকে ব্যবহার করা হত। প্রতিদিন কাজের সময় কানে ফুল, মাথায় পাখির পালকের মুকুটে ঘোড়াকে সজ্জিত করে গুছিয়ে রাখা হত।
জানা যায়, ১৭৭৫ এ উইলিয়াম জনসন নামক এক ইংরেজ ব্যক্তি কোলকাতার পন্ডিতিয়া অঞ্চলে প্রথম ঘোড়ার গাড়ির কারখানা স্থাপণ করেন। “স্টুয়ার্ট অ্যান্ড কোম্পানি” যারা কিনা প্রথম ভারতে রেলের যাত্রী কোচ তৈরী করেছিল তাঁরাই ১৮৮৩- ৮৪ তে ঘোড়া গাড়ির কারখানা তৈরী করেন “ ওল্ড কোর্ট হাউজ স্ট্রীট” এ। তারা ছিলেন তিন ভাই; জেসপ, রবার্ট এবং উইলিয়াম। ১৮২৭ সালে চার চাকার প্ল্যাটফর্ম বানিয়ে ঘোড়া দিয়ে টানালে সেই যানবাহনের নাম হয় “ব্রাউন বেরি”। আর “ব্রাউন বেরি”র সফলতার হাত ধরে পরবর্তীতে এরা রাস্তায় নামে কেরাঞ্চি, চ্যারিয়ট, এক্কা, টাঙা এসব নামে। এভাবেই ক্রমশ এই ঘোড়া চালিত গাড়ির জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে পূর্ববঙ্গেও।
কালের আবর্তে, যান্ত্রিক মোটর গাড়ির এই জয় জয়কার পূর্ণ সময়ে এই রাজকীয় যানটির গুরুত্ব এখন ততটা না থাকলেও পুরোনো ঢাকাতে এর সদর্প উপস্থিতি এখনও চোখে পড়ার মত। লোহা ও স্টীল এর তৈরী এই টমটম মুসলমানদের পবিত্র ঈদ উৎসবে, পহেলা বৈশাখে, সিনেমার শ্যুটিং, হিন্দুদের বিভিন্ন পূজা এবং জন্মাষ্টমিতে এখনও ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হয়। পুরোন ঢাকার বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানের জৌলুস বৃদ্ধি করতে ঘোড়া গাড়ি এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। ফুলের মালা দিয়ে আর নানা রঙের রঙিন কাগজ কেটে রঙিন করে সাজিয়ে তোলা হয় ঘোড়া ও গাড়ি দুটোকেই। এমন বিবিধ রকমের আচার অনুষ্ঠানে এর ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এটি আমাদের বর্ণাঢ্য ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ঝান্ডাকে এখনও সগৌরবে বহন করে যাচ্ছে।
বঙ্গবাজার, ফায়ার সার্ভিস, পশু হাসপাতাল, বকশিবাজার, নারিন্দা, সিদ্দিক বাজার, কেরানিগন্জ এলাকায় গড়ে ৪০-৫০ টি ঘোড়া গাড়ি এখনও চলাচল করে। রাজশাহী, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, দিনাজপুর, নওগাঁ ও যশোর অঞ্চলে আজও কিছু ঘোড়া গাড়ি যাত্রী ও মালামাল পরিবহন করতে দেখা যায়।
তবে দু:খের বিষয়, ঐতিহ্যবাহী এই পরিবহনটির শান শওকাত এখন প্রায় ঢলে পড়ার পথে। বিনিয়োগের তুলনায় লাভের অংক ততটা সুবিধাজনক না হওয়ায় এর সাথে বংশ পরস্পরায় জড়িত থাকা অনেক মানুষই এখন অন্য পেশার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছেন। তাছাড়া ঘোড়ার খাবার তথা ভুসি এবং ঘাসের মূল্যবৃদ্ধি, পশু চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, ঘোড়ার ওপর অমানবিক নির্যাতনের নিষ্ঠুরতা সর্বাপরি যথাযথ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই ঐতিহ্যবাহী স্মারকটি আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। যা অত্যন্ত দু:খজনক। যথাযথ আইন প্রয়োগ, সামাজিক সচেতনতা, অর্থনৈতিক অনুদান এবং সরকারী সহায়তা পেলে ইতিহাসের এই অমূল্য ধারক কে আমরা সহজেই আমাদের মাঝে ধরে রাখতে পারি। এতে করে আমাদের ইতিহাসের এক অমূল্য ধারা সুরক্ষিত থাকবে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মও সেই সোনালী দিনের ঝলমলে অধ্যায়ের রোমাঞ্চকে আস্বাদন করতে সক্ষম হবে।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট, (ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী: মুনতাসির মামুন), (আহসান মন্জিল ও ঢাকার নওয়াব। ঐতিহাসিক রূপরেখা: ড. মো: আলমগীর)।