বর্ণিল বাহারি হুডের আচ্ছাদনে বসে কাজে বা বেড়াতে যাওয়া, ছেলে-মেয়েদের রোজ স্কুলে পৌঁছে দেওয়া, অর্থ্যাৎ আমাদেরকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে যে যানটি জনপ্রিয় সেটা হলো ‘রিকশা’গুনগুন গানের সুরে এই তিন চাকার বাহনে নিজেকে সঁপে দেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। বস্তুত আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির এক অনুষঙ্গ যেন রিকশা।
ঢাকাকে বলা হয় ‘রিকশার শহর’। এই ব্যস্ত রাজধানীর বুকে প্রায় ১১ লাখ রিকশা রাজপথ থেকে শুরু করে অলিগলি চষে বেড়াচ্ছে বলে একটি পরিসংখ্যান জানাচ্ছে। এ সংখ্যাটা ১৯৪১ সালে ছিলো শুধু ৩৭।
বলা হয় জাপানি ‘জিন-রিকি-শা’ শব্দ থেকে এই ‘রিকশা’ শব্দের জন্ম। ‘জিন’ অর্থ মানুষ আর ‘রিকিশা’ অর্থ মানুষ চালিত বাহন। শুরুতে রিকশা তিন চাকার বদলে কিন্তু দুই চাকায় ভর দিয়ে দাঁড়াতো এবং এর সামনে ছিলো লম্বা এক হাতল। হাতল ধরে তখন ঠেলাগাড়ির মতো চালিয়ে নেওয়া হত এ বাহনকে।
আবার ‘রিকশা ইন সাউথ এশিয়া, ইন্ট্রোডাকশন টু স্পেশাল সেকশান’ গবেষণাগ্রন্থে এম. উইলিয়াম স্টিলি দাবি করেছেন, ১৮৬৯ সালের দিকে জাপানে কাহার- টানা পালকির বিকল্প হিসেবে এ রিকশার উদ্ভব হয়। দেশটির মিজি সম্রাজ্যের শাসনামলে নাকি এ রিকশা তৈরি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জ্বালানি সংকট রিকশা ব্যবহারের সম্প্রসারণ ঘটায়।
১৮৭০ সালের দিকে মানুষের বাহন হিসেবে রিকশা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে আকিহা দাইসু নামক একজন ব্যবসায়ী এ রিকশার আদলে আকর্ষণীয় পরিবর্তন নিয়ে আসেন। এরপর থেকে জনপ্রিয় এ বাহনটি অন্যান্য দেশ যেমন সাংহাই, হংকং, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনামে ছড়িয়ে পড়ে।
রিকশার রূপ রয়েছে কয়েক রকমের। বিচিত্র এ বাহনটির প্রকারভেদও কম নয়। বলা হয়, সিঙ্গাপুরে প্রথম যে ‘ট্রাইশ’ দেখা যেত, সেটাই নাকি এখনকার রিকশার আদিরূপ। দেখতে অনেকটা এ সময়কার রিকশার মতো হলেও সামান্য পার্থক্য দেখা যায় ওতে। এতে চালকের আসন মাঝামাঝি নয়, বরং এটি থাকে ডানদিকে এবং সিট বেশ নিচু। তবে আফসোস নেই, মিয়ানমার এবং ফিলিপাইন ঘুরতে গেলে এর দেখা মিলে যাবে বিলক্ষণ।
আবার আইসক্রিম ভ্যানের মতো কিছু রিকশা রয়েছে যাদের বলা হয় ‘সাইক্লো’। সাইক্লোর ডিজাইনার হিসেবে ফরাসি শিল্পী পিয়েরে কোপ্যুকে স্মরণ করা হয়। জানা যায়, কম্বোডিয়ার নমপেনে প্রথম এই সাইক্লোর নির্মাণ শুরু হয়। আর বাংলাদেশে এখন যে রিকশার আদল দেখা যায় এটিই মূলত রিকশার সবচেয়ে বিবর্তিত জনপ্রিয় রূপ। তবে এ সংস্করণ ধারণা করা হয়, থাইল্যান্ডেই প্রথম খুঁজে পাওয়া যায়।
ভারতবর্ষের মাটিতে এই তিন চাকার ছাপ জেগে ওঠে ১৮৮০-এ ছোট্ট সবুজ পাহাড়ি শহর সিমলাতে। শুরুর দিকে ব্যক্তিগত বাহন হিসেবে এটি ব্যবহৃত হলেও এর গগনচুম্বী চাহিদা উনিশ শতকের শেষ দিকে গণপরিবহনের কাতারে নাম লিখিয়ে নেয়। ঐতিহ্যবাহী নগর কলকাতায় এর বিজয় আগমন ঘোষিত হয় বিশ শতকের শুরুতে। আর সেখান থেকে পূর্ববাংলা অবধি যাত্রাপথ গড়ে নিতে এর সময় লেগে যায় প্রায় চার দশক!
তবে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে এর আগমন বার্মা থেকে ঘটলেও রাজধানী ঢাকায় এর রাজসিক আগমন ঘটেছে অন্য পথে। জানা যায়, ১৯৩৮ সালে কিছু ইউরোপীয় পাট ব্যবসায়ীর সাথী হয়ে রিকশা চলে আসে নারায়ণগঞ্জ ও নেত্রকোণায়। এগুলো ব্যক্তিগত চাহিদাই যোগান দিত তখন। তবে ঢাকায় সাধারণের বাহন হিসেবে রিকশা তার প্রয়োজনীয়তা মেলে ধরে ১৯৪১ সালে। আর সেই যে শুরু, তার সেই যাত্রা আজও অব্যাহত রয়েছে একইভাবে।
একটি পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের সব রিকশা মিলে বাৎসরিক আয়ের খাতে জুড়ে দেয় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এ টাকা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ঘোষিত বাজেটের ৮ শতাংশের সমান। এই ক্ষুদ্র গণপরিবহন মাধ্যম এদিক দিয়ে রেল কিংবা বিমান সেবাকে দিয়েছে টক্কর। প্রায় ১৫ লাখ রিকশাচালক এবং তাদের পরিবার এ রিকশার আয়ের ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া এর সঙ্গে জুড়ে রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রিকশা মিস্ত্রী, আঁকিয়ে, খুচরা পার্টস বিক্রেতাসহ আরও অনেকে।
দূষণমুক্ত পরিচ্ছন্ন এ বাহনটি সব শ্রেণির মানুষের কাছে এক রকম আদরণীয় বলা চলে। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সফর করতে আসা ইরানের প্রেসিডেন্ট রাফসানজানি এ রিকশায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। ২০১১-এর বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মঞ্চ অলংকৃত করেছিলো রিকশা। বিভিন্ন দেশের কাপ্তানরা সেদিন বিশ্ববেদীতে তাদের পদচিহ্ন এঁকে নিয়েছিলেন এ রিকশার তিন চাকাতে সওয়ার হয়ে।
আমাদের কথায়, গানে, সাহিত্যে, লেখায় জীবনের প্রতি অঙ্গনে এ তিন অক্ষরে বুনে নেওয়া নামখানি নিজেকে অনন্য মহিমায় উপস্থাপন করে নিয়েছে। বৃষ্টির দিনে রিকশার হুড ফেলে দিয়ে প্রকৃতির ছোঁয়া নিতে রিকশার কোন বিকল্প হয় না। এ চিরচেনা সাধারণ বাহনের সঙ্গে আমাদের সবারই জীবনের কোন না কোন অসাধারণ প্রাপ্তির গল্প জুড়ে রয়েছে।
রিকশা জুড়ে নিচ্ছে ভিন্ন সংস্কৃতির ধারাকেও। আমাদের পর্যটন শিল্প মাতিয়ে নিতে রিকশা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। টুংটাং সুরেলা আওয়াজের ছন্দ আর তিন চাকার গতিতে অবলীলায় সওয়ার হয়ে যাচ্ছে বিশ্ব সংস্কৃতির বর্ণাঢ্য ইতিহাস।