বিরিয়ানি; ভূ- ভারতের শাহী ভোজন উপাখ্যান

by soniatasnim
কথায় বলে, বাঙালি হয় ভোজন রসিক। কথাটা যে ষোল আনা খাঁটি সেটা প্রমাণ করা মোটেই দুঃসাধ্য কিছু নয়। আর বাঙাল মানেই রন্ধনে বৈচিত্র। আর সেটা যদি হয়, বিরিয়ানি প্রসঙ্গে, তাহলে তো কোন কথাই নেই। বলা হয়, হাজারো ভাষা, বর্ণ, গোত্র, জাতি ও ধর্মে বিভক্ত ভূ-ভারতবাসীকে এক টেবিলে বসাতে পারে মাত্র দুটো জিনিষ। একটি হলো ব্যাটে বলে ক্রিকেট আর আরেকটি এই বিরিয়ানি। বিরিয়ানীর প্রেমে মজেনি এমন কাউকে না-খুঁজে পাওয়া কেবল মুশকিলই নয় অসম্ভবও বটে। খাবারের স্বাদে বাড়তি মাত্রা জুড়ে দিতে এই ঐন্দ্রজালিক বিরিয়ানির জুড়ি মেলা ভার। ভারতবর্ষের চারশ বছরের বর্ণিল ইতিহাসের অধ্যায় থেকে আরাম্ভ করে আজ অবধি এই বৈচিত্র্যময় উপমহাদেশে মশলাদার চটক স্বাদযুক্ত অমৃত খাদ্যটির জনপ্রিয়তার আবেদন তাই আজও সমানভাবে অক্ষুণ্ণ। কি বিয়েবাড়ীর ধামাকা, কি ঈদের আয়োজন, তুলতুলে মাংসের টুকরো আর সুসিদ্ধ আলু সমেত বিরিয়ানি পাতে তুলে এর স্বাদের মাঝে হারিয়ে যাননি, এই ভূ ভারতে অন্তত এমন কাউকে মিলিয়ে নেওয়া যাবে না। হ্যাঁ। একদম ঠিক। আজ বলতে যাচ্ছি, মুখোরচক বিরিয়ানির সাতকাহন কথা।
কথা শুরু করবার আগে একটু ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখা যাক। বিরিয়ানির সূচনা ভারতবর্ষে কি করে হলো এই নিয়ে রয়েছে নানা মতবিরোধ। বলা হয়, বিরিয়ানির উৎপত্তি মূলতঃ এশিয়ার পশ্চিমাংশ থেকে। তুর্কি মঙ্গল বিজয়ী তৈমুর বিন তারাগাই বারলাস ১৩৯৮ সালে বিরিয়ানিকে ভারতবর্ষের সীমানায় পৌঁছে দেন। সে সময়ে একটা বিশাল মাটির হাঁড়িতে চাল, মসলা মাখা মাংস ও ঘি একসঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে ঢাকনাটা ভালোভাবে লাগিয়ে দেওয়া হতো। এরপর সবকিছু সেদ্ধ হয়ে যাওয়া অবধি গনগনে গরম গর্তে হাঁড়িটি মাটি চাপা দিয়ে রাখা হতো। সব শেষে সেই হাঁড়ি থেকে যে সুস্বাদু খাবার বের করে তৈমুরের তেজস্বী সেনাবাহিনীর উদর পূর্তি করা হতো ওটাই বিরিয়ানি নামে সুপরিচিত। মতান্তরে, ভারতবর্ষের মালাবারে দক্ষিণ উপকূলে তুরস্ক ও আরব ব্যবসায়ীদের আনাগোনার সাথেই ভারতবর্ষে এর আগমন ঘটে এমনও শ্রুতিকথাও অবশ্য প্রচলিত রয়েছে।
তবে, এ যাত্রায় মুঘল সম্রাজ্ঞী মমতাজ বেগম এক বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। কেউ জানেন কী? মুঘল এই সুন্দরী ইতিহাসে কেবল তাজমহলের কারণে যে অমরত্ব লাভ করেছেন এমনটি নয়। তাজমহলের শুভ্রতায় পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য সমৃদ্ধ করে নেবার সাথে সাথে ভূ ভারতের স্বাদের ঐতিহ্যকেও তিনি করে তুলেছেন ঐশ্বর্যশালী। শোনা যায়, একবার মুমতাজ বেগম মুঘল সৈন্যদের অবস্থা পরিদর্শনে ব্যারাকে যান এবং সেখানে তিনি সৈনিকদের স্বাস্থ্যের করুণ অবস্থা দেখে চরম ব্যথিত হন। যার পরিপ্রেক্ষিতে মেসের বাবুর্চিকে স্বয়ং নির্দেশ করেন চাল ও গোশত সমৃদ্ধ এমন পুষ্টিকর খাদ্য তৈরী করতে যা তাঁর সেনাবাহিনীদের ভগ্নপ্রায় স্বাস্থ্যকে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে। সম্রাজ্ঞীর আদেশ শিরোধার্য। তাঁর ফরমানেই বাবুর্চি যে মুখরোচক খাবারের রেসিপি প্রণয়ন করে নিয়ে পরে তাকে পাত্রে উপস্থাপন করেন, সেটাই বিরিয়ানির তকমা অর্জন করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, স্বাদের প্রতিযোগিতায় টক্কর দিয়ে মুঘলদের টেবিলে জায়গা করে নিতে জিবে জল আনা এই চাল-মাংসের সংমিশ্রণটির কিন্তু খুব বেশি সময় লাগেনি। ভারতের আনাচে-কানাচে এর বৈচিত্র ছড়িয়ে দিয়েছে মুঘলরাই। আর স্থানভেদে এটি এর প্রণয়ন শৈলী আর উপস্থাপনায় পেয়েছে নতুনত্বের ছোঁয়া। অনন্য স্বাদে ভিড়েছে নবনব সংস্করণ। তাইতো পূর্বে ঢাকা থেকে পশ্চিমের পেশোয়ার অবধি ঘোড়া ছুটালে এই বিরিয়ানির বৈচিত্র্যে বরাবরই মিলবে ব্যাপক তারতম্য।
মূল প্রসঙ্গে যাবার আগে আরও একটা ছোট্ট তথ্য দেই। বিরিয়ানি গোটা ভারতবর্ষে দাবড়ে বেড়ালেও এই শব্দটির মালিকানার সুঁতো কিন্তু সূদূর পারস্য সম্রাজ্যের নাটাই এর সাথে জুড়ে। ফারসি শব্দ ‘বিবিয়ান’ মানে ‘রান্নার আগে ভেজে নেওয়া’ আর ‘বিরিঞ্জ’ অর্থ হলো ‘চাল’। তাহলে অর্থ দাঁড়াচ্ছে, রান্নার আগে ঘি দিয়ে সুগন্ধি চাল ভেজে নেওয়ার কারণেই এর নাম ‘বিরিয়ানি’। আমাদের দেশের অনেক অঞ্চলে, বিশেষত, বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে যে “বিরান করা” শব্দটি ব্যবহার করা হয় তা কিন্তু এই ফারসি শব্দ থেকেই এসেছে।
এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, বিরিয়ানি কত প্রকার, তবে এর সঠিক উত্তর বলা মুশকিল। কারণ, পুরো পৃথিবীতে প্রায় কয়েকশ বিরিয়ানি তার স্বাদের রাজত্ব করে চলছে। ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ তার ভিন্ন ভিন্ন নাম। তবে নামে পার্থক্য থাকলেও তাদের রন্ধন প্রক্রিয়া মোটামুটি একই। বিরিয়ানির আসল বৈচিত্র্য খেলা করে এটার মাঝের বাহারি মশলার ব্যবহারে। আর সবচেয়ে বড় যে ব্যাপার, এই খাবারটির স্বাদের মূলমন্ত্র হলো একে “দম” দিয়ে রান্না করবার কৌশল। তবে জগত বিখ্যাত কিছু বিরিয়ানির নাম যদি বলতেই হয়, তাদের মাঝে ঢাকাই, হায়দ্রাবাদি, সিন্ধি, লৌখনৌউ, বোম্বাই, থালেশ্বরী, কোলকাতাই, মালাবারি বিশেষ আসন অধিকার করে রয়েছে।
আমাদের দেশে কাচ্চি ও পাক্কি দু’ ধরনের বিরিয়ানির প্রচলন থাকলেও কাচ্চি বিরিয়ানির জনপ্রিয়তা আর আবেদন আকাশচুম্বী। যেহেতু সুগন্ধি চালের সাথে গোশত সরাসরি রান্না করা হয়, তাই এর নাম ‘কাচ্চি’। উর্দু শব্দ ‘কাচ্চা’ র বিবর্তিত রূপ ‘কাচ্চি’। যার অর্থ হলো ‘কাঁচা’। চাল, কাঁচা আলুর ওপর টকদই ও মশলায় মেখে রাখা কাঁচা মাংসের আস্তরণের স্তূপকে হাঁড়ি বন্দী করে ঢাকা (তাল বা ডো dough) চাপা দিয়ে দমে রান্না করা হয়। শর্করা প্রোটিনের পুষ্টি গুণের এই মিশেল ঘি, জাফরান, গোলাপজল, কেওড়াজলে সিক্ত হয়ে, দমে প্রস্তুত হয় এই অতুলনীয় কাচ্চি। আর ঢাকাই কাচ্চি নিয়ে আলাদা করে কোন পরিচয় বা বিশেষণ দেওয়া একেবারেই নিষ্প্রয়োজন। কেন বলছি? বস্তুতঃ মুঘলদের জাদুকরী ব্যঞ্জনশিল্পে সওয়ার হয়ে যতরকমের মোগলাই খাবার ঢাকায় আধিপত্য বিস্তার করে নিয়েছে তার মাঝে বিরিয়ানি চোখ বুঁজে অগ্রাধিকার পাবার দাবীদার। ইতিহাসের সোনালি পাতার আলোকে, ১৯৩৯ সালে হাজী গোলাম হোসেন সাহেবের বনেদী হাত পাঁকড়ে ঢাকাতে শুরু হয় বিরিয়ানির অগ্রযাত্রা। মূলতঃ হাজীর বিরিয়ানি থেকেই ঢাকায় জন্ম নেয় এই মশলাদার শিল্প। মোলায়েম গোশত আর সুগন্ধি চালের এই গ্রাস একবার যে মুখে পুরেছেন কেবল মাত্র সেই অনুধাবন করতে পারবেন এর মর্মার্থ। পুরোন ঢাকার ফখরুদ্দিন, চানখারপুলের হাজী নান্না, নারিন্দার ঝুনুর বিরিয়ানি রীতিমত লিজেন্ড এর ঝান্ডা বহন করে চলছে যুগযুগ ধরে। ঢাকাই কাচ্চিকে বলা হয়, রাজধানীর অন্যতম ট্রেডমার্ক। এমন বলাটা সমীচীন বটে।
সত্যি বলতে কি, আমাদের খাদ্য সংস্কৃতির ইতিহাসে ঢাকাই বিরিয়ানির ঐতিহ্য এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে। আর ঢাকাই কাচ্চি নাম শুনলে পেটের মাঝে ইদুর দৌঁড় শুরু হয়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। বর্তমানে কেবল নতুন পুরোন ঢাকার সুরঙ্গ পথেই নয়, ঢাকাই বিরিয়ানির নির্যাস ছড়িয়েছে শহর থেকে শহরে এমনকি ভৌগলিক সীমারেখা পার করে সূদূর প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে। খবরের কাগজের পাতা থেকে শুরু করে ওয়েব দুনিয়ার ভার্চুয়াল পর্দায় এর স্তুুতির জয়জয়কার। পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় নানা অনুষ্ঠানের পছন্দের খাদ্য তালিকায় সর্বদা শীর্ষে থাকা এই বিরিয়ানির কদর বলতে গেলে সত্যি ঈর্ষণীয়। যার অনবদ্য স্বাদ আর অনিবর্চনীয় উপস্থাপনার সঙ্গে অনায়সে জুড়ে যায় আপ্যানকারীর শাহী রুচিবোধ, মানমর্যাদা আর শান শওকাত। জাদুকরী এই ব্যঞ্জন স্বাদ গাঁথায় অতি সহজেই জুড়ে যায় সম্পর্কের নব নকশিকাঁথা। ভাঁপে বসানো সুবিশাল হাঁড়ির মাঝে থেকে ভুরভুরিয়ে বেড়িয়ে আসা বিরিয়ানির সুগন্ধে উদ্বেলিত বাতাস বয়ান করে যায় এর অলিখিত অতুলনীয় স্বাদের উপাখ্যান৷ তাতে সার্থক মুচকি হাসির রেখ জেগে ওঠে রাজকীয় পুষ্ট গোঁফে তা দেওয়া দক্ষ বাবু্র্চীর ঠোঁটের কোণে। আর, ভোজন রসিকদের আমুদের কথা না হয় না-ই বা বললাম। সেকথা বরং থালি পর্বের জন্যই তোলা থাক। ও বিবেচনা আপনাদের ওপরেই ছেড়ে দিলাম। আসলে মশাই, এটা এমন আখ্যান, যা শুধু মাত্র জিবেই পরখে নেওয়া সম্ভব, কলমের কালিতে নয়। তবুও বিখ্যাত রম্যসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় অগত্যা বলে নেবার দুঃসাহস করেই নিচ্ছি, “একি ভানুমতি! একি ইন্দ্রজাল!
তথ্যসূত্রঃ পত্রপত্রিকা, ইন্টারনেট, জার্নাল

Related Posts

Leave a Comment