“ঋতুর দল নাচিয়া চলে
ভরিয়া ডালি ফুলে ও ফলে
নৃত্য- লোল চরণতলে
মুক্তি পায় ধরা–
ছন্দে মেতে যৌবনেতে রাঙিয়ে ওঠে জরা।”
কবি গুরুর এই পংক্তি মালার মধ্য দিয়ে যেন বাংলা বর্ষ পরিক্রমার যথার্থ রূপটাই ফুটে উঠেছে নিপুন ভাবে। বাংলার ঋতু রঙ্গের এই সৌন্দর্য লীলার প্রেমে মজেন নি এমন কোন বাঙালি খুঁজে মেলা ভার। আবেদনময়ী প্রকৃতির এই মোহনীয় রূপ যেন অনায়সেই সকলের মনের মাঝে ঘুমিয়ে পড়া ভাবুক কবি সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলে অকপটে। ঋতুর এই বর্ণিল বৈচিত্রে সাড়া দিয়ে তাই যুগে যুগে রচিত হয়েছে কত কত আকুতি আর পরিণয়ের আখ্যান৷ প্রকৃতি আর প্রেমের মাঝে যে সুর জালের বিন্যাস রচিত হয়েছে অলক্ষ্যে, তাকে উপেক্ষা করে কার সাধ্যি? তাইতো এর মোহনীয় সৌন্দর্যে প্রতিনিয়তই সৃজিত হয়ে চলেছে নব নব কাব্য আর গীতি কথার মালা।
বর্ষ পরিক্রমায় ঋতু চক্রের অবারিত মঞ্চে পালা করে একে একে যে ছয় কুশীলব আবর্তিত হয় গ্রীষ্ম তার মাঝে প্রথম। ষড় ঋতুর এই বর্ণিল আয়োজনের যাত্রা পথে প্রথম পালকটি তাই সংযোজিত হয় গ্রীষ্ম রাজের মুকুটে। রঙ বেরঙের বর্ণিল সমাহার আর নিষ্ঠুর রিক্ততার সংমিশ্রণে প্রকট হয় গ্রীষ্ম রাজের রূপ। এর দোর্দণ্ড প্রতাপ যেমন ফেলে আসা দিনপঞ্জিকার ব্যধি আর জরার আবর্জনাকে চিতার অনলে বিসর্জন দেবার অভিপ্রায়ে মত্ত হয়ে ওঠে তেমনি এর কোমল তুলির স্পর্শে প্রকৃতি পটে জেগে ওঠে বর্ণিল সমাহার। এ যেন একই অঙ্গে সাজানো আশ্চর্য দুই রূপ! একটি রুদ্র মূর্তিতে অপশক্তির বিনাশে মত্ত তো অপরটি ছুটে চলে নব সৃষ্টির উন্মাদনার জোয়ারে। বাংলার বর্ষ পঞ্জিকার যাত্রা শুরু হয় এই মোহনীয় গ্রীষ্মের হাত ধরে। বৈশাখ এবং জৈষ্ঠ্য এই দুমাস ব্যাপী স্থায়ী হয় গ্রীষ্মকাল। অনন্য তার রূপ, অনন্য তার আবেদন। মৌণ ধ্যান রত সন্নাস্যী যেন আচমকাই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে এই সময়ে। ওর রাগান্বিত চোখের তারায় জেগে অভিশাপের হলকা যেন ছুটতে চায় চরাচরে। ক্ষুধার্ত কোন রাক্ষসী বুঝি তার লকলকে জিহ্বায় লেহন করে নিতে চায় সমস্ত প্রকৃতি সুধা। চারদিকে কেবলই রিক্ততা জাগে। এমন করেই উষ্ণতা আর শুষ্কতার অলংকার নিজ অঙ্গে সাজিয়ে নেয় গ্রীষ্ম। ক্ষণ জন্মা নিশি আর দাপুটে দিবস ভাগ জুড়ে থাকে এর দৌরাত্ম।
সোনালি দ্বিপ্রহরের ঢলে পড়া আঁচল যেন হাহাকার করে ওঠে একটু সঞ্জীবনীর ছোঁয়া পাবার আশায়। সুচষ্মিতার আকুল আবেদন যেন বারবার আঁছড়ে পড়ে এই ঋতু রাজের পদ চরণে৷ অতঃপর আচমকাই ঘটে ছন্দ পতন। মল পায়ে কিশোরী পশ্চিমা মৌসুমী বায়ুর নৃত্যের তালে ছন্দ মিলিয়ে নিতে সামিল হয় পশ্চিম ও উত্তর- পশ্চিম রাজ্য থেকে ধেয়ে আসা শীতল শুষ্ক যুবক বায়ু রাজ। দুজনের চপল সংঘর্ষে প্রকতিতে জাগে নাদ। চরাচর কাঁপিয়ে হঠাৎ বেজে ওঠে প্রলয় শঙ্খ। বিস্তৃত গগনের আঁচলে স্তরে স্তরে জমে উঠতে থাকে কৃষ্ণ মেঘের স্তুপ। যেন রণ সাজে সজ্জিত ক্ষত্রিয় সেনার দল উন্মত হয়ে ওঠে প্রলংকয়ী কোন যুদ্ধ জয়ের নেশায়। শুরু হয় প্রলয় নৃত্য। ভয়াল কাল বৈশাখীর উন্মাদনায় মাতমের সুর জাগে সর্বত্র। মহাকাল যেন থামিয়ে নিতে বাধ্য হয় তার সেই অনন্ত পথ চলার গতি। সিক্ত হয় ধরা। ধ্বংস যজ্ঞের কলংক মাথায় চাপিয়ে লাজের মূর্ছনায় ভেসে যায় চরাচর। আগুন রাঙা কৃষ্ণচূড়া আর হলুদিয়া বরণ হলুদ সোনালুর অর্ঘ্যে ভরে ওঠে পরিণয়ের ডালি খানি। লাল সাদা কাঠ গোলাপ আর বেগুনি জারুলের আবেদনময়ী রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নেয় প্রকৃতি রানী। রসিক বাঙালির দরজায় করা নাড়ে মধু মাসের ডাকপিওন। আম, জাম, তরমুজ, কাঠাল, লিচুর রসে ভরে ওঠে মুখ। বাতাসে মিশে যায় গোলাপ, বকুল, বেলি, টগরের মম সুবাস।
মূলতঃ বাংলার ঋতুরাজ বসন্ত কালকে বলা হলেও গ্রীষ্ম কাল কিন্ত রাজকীয়তার দৌরাত্ম্যে কম যায় না। গ্রীষ্ম দিয়েই শুরু বাংলা বর্ষের যাত্রা। নববর্ষের সেই মহালগ্নে আনন্দে উদ্বেলিত হয় সব বাঙালি প্রাণ৷ প্রকৃতির নব যাত্রার সাথে আমরা সকলেই জীবনের নতুন জয়গানের সূচনা করি। হালখাতার আমেজ, জামাই ষষ্ঠীর কলতানে যেন আবহমান বাংলার কৃষ্টি নতুন করে মেতে ওঠে৷ গ্রীষ্ম আমাদের স্বপ্ন দেখতে শেখায়। অবার্চীন ধ্বংস স্তুপ পায়ে ঠেলে মাথা উঁচু করে নতুন ভাবে বাঁচতে শেখায়। গ্রীষ্ম মানে নব সূচনা, গ্রীষ্ম মানে লাল সাদার বিজয় কেতন, গ্রীষ্ম মানে বাতাসে ভাজা ইলিশের ঘ্রাণ, গ্রীষ্ম মানে রিক্ততার মাঝে পূর্ণতার আনন্দ, গ্রীষ্ম মানে প্রিয়ার খোঁপায় মুখ লুকোনো রক্তিম কৃষ্ণ চূড়ার লালিমা, গ্রীষ্ম মানে পাকা জামের মধুর রসে মুখ রঙিন করে নেওয়া, গ্রীষ্ম মানে রবি ঠাকুরের মন কাড়া সুরের আমেজের কল্লোল ধারা। হ্যাঁ। গ্রীষ্ম মানে, বলা না বলা এমন আরও অনেক কিছুর সুর…