চাঁদের হাসি

by soniatasnim
সময়টা ষাটের দশকের। ধনুকের মত বাঁকা কাটাখালি ব্রীজের দক্ষিনে যে ন্যাড়া মাঠ তার ঠিক পশ্চিম দিকে বকু সন্ন্যাসীর মতন ডাল পালা মেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রকান্ড এক রেইন ট্রি। ওটার ডালে ডালে সজ্জিত সবুজ ঝিরঝিরে পাতার মাঝে শিশু অনীল দিনভর দৌড়ে বেড়ায়। বিন্যস্ত শাখা প্রশাখার ফাঁকে ফাঁকে অতবড় বিস্তীর্ণ আকাশটাকে কেমন ছেঁড়া ছেঁড়া দেখায়। দূর গগন থেকে সাঁতরে আসা কাঁশফুলের মত কিছু মেঘ যেন ঐ খাম্বার ন্যায় বৃক্ষটির মাথার ওপর এলিয়ে পড়ে। তখন ওটাকে দেখতে অনেকটা ইদ্রিস দাদুর মত দেখায়। কেমন অদ্ভুত ব্যাপার! প্রতিদিন বিকেলে যখন রবির বেগুনি রঙা আঁচল ঐ এক ফালি মাঠের ওপর বিছিয়ে পড়ে সেই মায়া লগ্নে চুপ করে এসব দেখে যায় বাবলু। ওর কৌতুহলী দৃষ্টি যেন রেইন ট্রির উচ্চতাকেও ছাড়িয়ে চলে যায় আরও দূর থেকে দূরান্তে। কত শত কথা মনের আকাশে ঐ পেঁজা বারদ দলের মতই পরস্পরকে ছুঁয়ে যায়। আজও তেমনি বাবলু এসে দাঁড়িয়েছে এখানটাতে। রবি রাগের শেষ কিরণ তখন বিরহ বিদায় নিতে ব্যস্ত। একটু আগেই মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ওঠা মাগরিবের সুললিত সুর বাতাসে কেমন হাওয়াই মিঠার মত মিশে গিয়েছে। কোনমতে নাকে মুখে দুটো খোরমা আর জিলিপির টুকরো পুড়ে এদিকে দৌড় দিয়েছে বাবলু। আজ ঊনত্রিশ রমজান। পশ্চিমাকাশে আজ চাঁদ দেখা গেলে কাল ঈদ। ঈদ-কথাটা মনে হতেই এক অন্যরকম শিহরণ জাগে বাবলুর মনে। দেরাজে সযত্নে তুলে রাখা সাহেবী প্যান্ট আর কুর্তার কথা মনে পড়ে যায় ওর। করাচীর মাস্টার কোম্পানীর লেবেল আঁটা ওতে। দপ্তরের কাজে বাবা গিয়েছিলেন কতদিন আগে সেখানে। আসবার সময় হাতে নিয়ে এসেছেন নতুন খুশির লহমা। আব্বার কাছে শুনেছে বাবলু, করাচী নাকি এখান থেকে ম্যালা দূর! ঐ যে কি যেন নাম ওটার, কুচকুচে কালো রঙ শুয়ো পোকার মত এঁকে বেঁকে চলে। হ্যাঁ। মনে পড়েছে! ট্রেন! বেজায় রাগ নাকি ওটার। চলবার সময় নাকি দু প্রান্ত দাবড়ে ছোটে, ওটার ক্রুদ্ধ গর্জনে নাকি আকাশ পাতাল কেঁপে ওঠে তেমনি ওর নাক দিয়ে নাকি গলগল করে কালো ধোঁয়া বেরুয়। বাবলু ভয়ে সিঁটিয়ে যায় কেমন। অবশ্য বাবা বলেছে ভয়ের কিছু নেই। ওটি কাওকে ধরে নিয়ে যায় না। একদিন বাবলুও চেপে বসবে ওতে বাবার সঙ্গে। ব্যাস! ও কেবল আরও একটু বড় হলেই হল। স্বস্তির নি:শ্বাস বেড়িয়ে আসে বুক চিঁড়ে ওর। বাবা সঙ্গে থাকলে আর ভয় কি? বাবার মুখটা মনে হতেই আচমকা বাবলুর মনে হয় দুপুরেই তাঁকে দেখেছে চকচকে আধুলি আলাদা করে তুলে রাখতে। কাল নামাজ শেষে চলবে সেলামী আদায়ের হিড়িক। মুঠো ভরে উঠবে রূপালি আনন্দে। আনমনে নিজের হাতের মুঠিতে একবার নজর বুলিয়ে নেয় বাবলু। ইস! কি যে আনন্দটা হবে কাল! তবে কাল কি ঈদ হবে আসলে? আজ যদি এই আকাশে চাঁদ না ওঠে? তবে? দুপুরে যমুনার ঢেউ সাঁতরে যে গয়না নৌকা এসে ভিড়েছে। ওর রাক্ষুসে উদর থেকে উগরে আসা পিলপিলে মানুষের মাঝে বড়পা আর দুলাভাই ও এসেছে। ঘাটে গিয়েছিল বাবলু ওদের নিয়ে আনতে। দুলা মিয়ার হাতে ধরা পোড়াবাড়ির চমচমের হাড়িটা দুলছিল অল্প অল্প। লোভী মাছির মত বাবলুর দৃষ্টি ভনভনিয়ে যাচ্ছিল ওটার ওপর ।
– কি শ্যালক বাবু! কাল কি ঈদ হবে?
– আলবাৎ
– উঁহু! কি করে বললে? আজ যদি চাঁদ না ওঠে? তবে?
দুলাভাইয়ের মুখে চিন্তার ছাপ, মুখে মিটমিটে হাসি। আড়চোখে আপার দিকে চোখ টিপে নিল বুঝি। আপার উত্তর তো বুঝা গেল না কেবল মাথার ঘোমটাটা আরেকটু ঝুলে পড়ল। ওতে অবশ্য খেয়াল দেয় নি বাবলু। মনের আকাশ এক টুকরো শংকার মেঘে ঢেকে যায়। তাইতো! এটাতো ভেবে দেখা হয় নি। তবে? হুট করে কেমন এক মন খারাপের শেকড় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে থাকে বাবলুকে। সেই চিন্তামনি এখন অবধি পিছু ছাড়ে নি ওর। ঢিবঢিব বুকে তাই আকাশের দিকে চেয়ে রয়েছে ও একদৃষ্টে। আপনমনে এবারে নিজের আঙুলের নখ খুঁটতে থাকে ও।
– কি রে বাবলু? দেখেছিস চাঁদ?
রতন এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। সঙ্গে ফারুক, মাসুদ, বিভু, হারেস, আরও কতজন রয়েছে। সবার দৃষ্টি ঐ আকাশের গায়ে ঠিকরে পড়ছে। দু চোখের তারার মাঝে খেলছে উৎকন্ঠার ঢেউ! বাবলু মাথা নাড়ে কেবল। রেইনট্রির মাথা দুলছে বাতাসে। অসীমে ঝুলতে থাকা দু চারটে মেঘ নিজেদের এলিয়ে দিয়েছে কেমন। শ্যালো মাঠটির কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গিয়েছে এর মাঝেই। সবার নি:শ্বাসে যেন ভারী হয়ে পড়ছে বাতাস। মনের মাঝে দোলাচলের তরঙ্গ কি হয় কি হয়! আচানক সুবলের গলা ফাটানো চিৎকার কানে এসে বাজে
– আব্বে বাবলু, ঐ দেখ, দেখ চাঁদ!
সকলের মাঝে শুরু হয় গুন্জন। জোড়া জোড়া চোখ যেন বিঁধে পড়তে চায় আসমানে। চাঁদ দেখা গেছে- সুবলটা ষাড়ের মত চেঁচিয়ে যাচ্ছে একনাগাড়ে। কি দিয়ে কি দেখেছে বেকুবটা। আল্লাহ জানে। ওর কথায় কান না দিয়ে সবাই অনুসন্ধানে নেমে পড়ে আবার। আর তারপরই গগন ফাটানো সমস্বর চিৎকার। ঐ যে! ঐ তো চাঁদ। হুল্লোড়ের ঢেউ জাগে বুঝি। বাবলুর বুকে বুঝি ঢাক পেটাচ্ছে কেউ। দু হাতে চোখ কচলে নেয় ও। কোথায় চাঁদ? ওর চোখে কেন পড়ছে না? ইতিউতি উঁকি ঝুঁকি দিতে থাকে ও। আর এর মাঝেই হঠাৎই শূণ্যে চোখ আটকে যায় ওর। আরে হ্যাঁ। ঐ তো! কি ওটা? গাছের মরা শাখার ওপরে নৌকার মত বেঁকে থাকা এক ফালি চাঁদ। কি সুন্দর আকাশের কোলে চুপটি মেরে বসে রয়েছে। কাল ঈদ সত্যি! আনন্দে বাবলুর চোখে জল চলে আসে। কি আনন্দ! একটু পরেই নতুন গামছায় পুটুলি করে মা জর্দার নতুন চালের পানি ঝড়াতে দেবে। হেসেল ঘরে পাটার শব্দ শোনা যাবে ঘটঘট। থকথকে মেহেদীর স্তরে উপচে পড়বে পাত্র। আপারা সব সেই লাল টকটকে মেহেদী পড়বে হাতে। রাত পোহাবার আগেই ওদের হাতে ধরবে গাঢ় রঙ। রেণু বুঝি এতক্ষণে ওর পুতুলগুলির নতুন জামা তুলে দিয়েছে। নতুন জামার কথা মনে হতেই সুবলের মুখটা মনে হয় বাবলুর। হতচ্ছাড়াটা গেল কই? এতক্ষণ তো খুব গলা সাধছিল। ভিড়ের মাঝে ওকে খুঁজে বেড়ায় বাবলু। নাহ! কোথাও নেই। সুবল যেন জনস্রোতে হারিয়ে গিয়েছে। সুবলের নতুন ধুতিটা দরজি পাড়া থেকে আনতে হবে জলদি। মা ওর জন্য ধুতি পান্জাবী বানাতে দিয়েছে আনোয়ার দর্জির কাছে। ওটা কি তৈরী হয়েছে পুরোপুরি? তা না হলে কাল সুবল নতুন জামা কি করে গায়ে চাপাবে? গেল পূজাতে কাকিমা নতুন কুর্তার সাথে বেশ করে লুচি রাবড়ি সন্দেশ খাইয়ে দিয়েছিল। কাল মায়ের হাতের পায়েস, জর্দা দিয়ে আচ্ছামত ভূড়ি ভোজ করাতে হবে সুবলকে। সেবারে যেমন একসাথে ওরা রথের দড়ি টেনেছে তেমনি কালও একসঙ্গে ঈদের সেলামীও জোগাবে ওরা। খুব মজা হবে তবে। বাবা বলেছেন, সবার আনন্দের মাঝেই ঈদের খুশি লুকিয়ে। হ্যাঁ। ঈদের খুশি ছড়িয়ে দিতে হবে সবার মাঝে। তবেই না ষোলআনা আনন্দ। কথাটা মনে পড়তেই বাবলু সচকিত হয়ে ছুট লাগায়। বাবলু তুফান বেগে ছুটছে। ওর পেছনে তখনও কোলাহল। নীল আকাশে কোমল স্নিগ্ধতা বিলোচ্ছে পবিত্র শওয়াল মাসের চাঁদ। ওর নরম আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। তাতে ধুয়ে যাচ্ছে মৌণ প্রকৃতি। বাবলু হাত বাড়িয়ে সেই স্নিগ্ধতা ছুঁয়ে দিতে চায়। ওর চোখে মুখে এক রাশ আনন্দ খেলে বেড়াচ্ছে। সেই আনন্দ সাম্যের, সেই আনন্দ ঐক্যের, সেই আনন্দ সম্প্রীতির। শনশন স্নিগ্ধ বাতাস বইছে ভূবনডাঙার পরে। আর তাতে ভেসে বেড়াচ্ছে রঙিন সুতো কাঁটা ঘুড়ির মত সেই চির মধুর অভিবাদন – “ঈদ মুবারাক”!

Related Posts

Leave a Comment