বাবা

by soniatasnim
এত সুন্দর সাজানো, গোছানো, ছিমছাম, নিপাট এই ঘরটার মাঝে থেকেও আরিশার কেমন দম বন্ধ লাগছে। শেকড় সহ একটি গাছকে তুলে নিয়ে নতুন মাটিতে রোপন করলে প্রথমে যেমনটা হয়, এই অনুভূতিটা অনেকটা সেই রকম। হতে পারে, নতুন পরিবেশের কারণে এমন মনে হচ্ছে। এই পর্যন্ত সব সময় নিজের ঘরে নিজের মত করে থাকাতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছে আরিশা। টিপটপ, পরিপাটি সাজসজ্জার ও কখনো থোরাই কেয়ার অবধি করে নি। দিনশেষে ব্যাস, কোনমতে বিছানায় নিজেকে এলিয়ে তুলতুলে বালিশে নাক মুখ গুঁজে নিয়েছে। কাল পর্যন্ত একই নিয়ম ছিল, আর আজ! একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে আরিশা। জীবন আসলেই বড্ড বিচিত্র। মানুষও কি বিচিত্র কম? কত সহজেই কত অল্প সময়ের মাঝে নিজেকে ছাঁচ থেকে আরেক ছাঁচে ঢেলে নেয় সত্যি! সামনের স্বচ্ছ দর্পনে নিজের প্রতিবিম্বকে অবাক হয়ে দেখে একবার। অল্প সময়ের ব্যবধানে কত পরিবর্তন! আজ আরিশার নতুন জীবন শুরু। শুরু নতুন করে পথ চলা। নতুন মুখ, নতুন সম্পর্ক, নতুন দায়িত্ব! এসব ভাবতেই মনের মাঝে কেমন অজানা এক অস্থিরতা অনুভব করে ও। আচ্ছা, পারবে তো সব ঠিকঠাক মত সামলে নিতে? বাসায় তো সব সময় নিজেকে সেই ছোটটাই মনে হয়েছে৷ কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আচমকা কত বড় হয়ে গিয়েছে ও এক পলকেই। কি অদ্ভুত! আসলেই! সবার কথা মনে হচ্ছে খুব। মায়ের মলিন মুখটা, ছোট বোনটা, আদরের ভাইটা, আর বাবা! হঠাৎ বাবার কথা খুব করে মনে হয়। চলে আসবার সময় বাবা কেঁদেছিল বেশ। যদিও সেটা ছিল নীরবে, গোপনে, তবে সেটা আরিশার চোখ এড়ায়নি মোটেও। বাবার মতই আরিশা ও সেটা অবশ্য বুঝতে দেয় নি কাওকে। আসলে প্রতিটা মানুষের ভেতরেই বুঝি একটা অভিনেতা সত্ত্বা বাস করে। বিদায় বেলাতেও মুখের হাসিটা কত সহজে ধরে রেখেছিল বাবা! ওর মাথাটা বুকে চেপে কেবল ধরা গলায় বলেছিল, “ভাল থাকিস”। উত্তরে তখন কেবল একটু হাসি হেসেছিল আরিশা। বুঝটা আসলে কাকে দিয়েছিল ও? বাবাকে না নিজেকে? নিজেকেই প্রশ্নটা করল যেন। উত্তরটা মেলে না অবশ্য, কাগুজে উড়োজাহাজের মতই কৌতুহলটা কামরার কোন কোণে লুকিয়ে পড়ে। আচ্ছা, বাবা এখন কি করছে? ঘুমিয়ে পড়েছে কি? আড়চোখে দেওয়াল ঘড়ির দিকে দেখে আরিশা। রাত একটা বেজে আট! নাহ! হিসেব অনুযায়ী তো এখন ঘুমোবার কথা নয়। আচমকাই হাসি পায় ওর। কি যে সব আবোল তাবোল ভাবনা ভাবছে! আজ, কি আসলেই বাবা চোখ বুঁজতে পারবে? আরিশা নিজেও কি পারবে তা? আরিশা আনমনে ভেবে যায়, ছেলেবেলায় খেলাচ্ছলে পুতুলের কত বিয়ে দিয়েছে ও। ওর ক্ষুদে ক্ষুদে আদুরে হাতে সাজানো খেলাগুলো খুব মন দিয়ে দেখত বাবা। অপরিপক্ক হাতের সেই ঘর গড়বার খেলা দেখে পরিণত সেই চোখ জোড়াতে জোৎস্নালোকের ন্যায় জেগে উঠত অনাগত দিনের বর্ণিল স্বপ্ন। আর সব বাবাদের মত নিজের রাজকুমারীকে এমন সুন্দর সাজে দেখবার অনেক শখ ছিল বাবার। এই দিন কে নিয়ে তাই বাবার কত রঙধনুর সাত রঙা স্বপ্ন, কত কল্পনা! তবে আরিশা কিন্তু উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখাত। এই তো কতদিন আগেও বাবা এমন কথা বললেই কি ভীষণ রেগে যেত আরিশা! গাল ফুলিয়ে বলত
– আমি কি তবে বেশি হয়ে গেছি, তোমাদের জন্য, বলতো?
ওর সেই ছেলেমানুষিতে বাবা কেবল হাসত। কিন্তু অজান্তেই সেই দিন যে এত জলদি চলে আসবে সেটা বুঝি বাবা নিজেও বুঝতে পারে নি। চিন্তা ভঙ্গ হয় হঠাৎ। রাতের নি:স্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে নিচে রাস্তায় এক বাইকের ভটভট আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কেউ মনে হয় বাইক পার্ক করাচ্ছে। অসময়ের বেসুর এই যান্ত্রিক শব্দটা কেমন ভাবুক করে তোলে আরিশাকে। এই ছন্দের সঙ্গে যে ওর দারুণ হৃদ্যতা জুড়ে রয়েছে! মনের আঙিনায় ঝরে পড়া শুকনো পাতার মতন কত শত স্মৃতি উঁকি দেয়। আরিশার মনে পড়ে, টিউশানি করবার সময় ও বাবার বাইকে চেপে যেত সব জায়গায়। পেছন থেকে শক্ত করে বাবাকে জাপটে রাখত দুই হাতে। প্রথম প্রথম খুব ভয় হত, পরে অবশ্য সাহস হয়ে গিয়েছিল। বাবা তখন হাসতে হাসতে বলত
– ভয় নেই কোন। ইনশাআল্লাহ। শক্ত করে ধরে রাখ, বাবাকে। পড়বি না বোকা মেয়ে, বাবা আছি তো!
আরিশার এই মুহুর্তে খুব ইচ্ছে হচ্ছে বাবার হাতটা আবার অমন করে শক্ত করে চেপে রাখতে। বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে হাত বাড়িয়ে বাবাকে একবার ছুঁয়ে দিতে। কি করবে ও এখন? বাবাকে ফোন করবে কি? আনমনে মুঠো ফোনটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে, আবার সেটাকে সরিয়ে ফেলে পর মুহুর্তে। নাহ! থাক, কি বা বলবে এখন? বলবার মত কোন কিছু খুঁজে যে পাওয়া যাচ্ছে না। এক প্রকার জোর করে চোখ বুঁজে নেয় আরিশা। মনে মনে মৌণতারা অনুভূতির সুতোর জাল বুনতে থাকে। অসীমে ভেসে বেড়ানো মেঘেদের মত কত টুকরো টুকরো স্মৃতি সাঁতরে চলে মনের আকাশে! বাবার কপট শাসন, আদর করে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা, মুখে লোকমা তুলে ভাত খাইয়ে দেওয়া, এমন আরও কত কিছু! বন্ধ চোখের পাতায় কি সহজেই না বাবা এসে হাজির হয়েছে। মুখে লেগে রয়েছে সেই হাসিটা! বাবা হাসছে। প্রবল বাতাসে বাবাকে কেমন এলোমেলো দেখাচ্ছে। বাবা হাত তুলে কাকে যেন ডাকছে। কাকে ডাকছে বাবা? আরিশা অবাক হয়ে দেখে যায়, সামনে ওটা কে? আরিশা না? হ্যাঁ৷ ওই তো, কিন্তু কি আশ্চর্য! সময় যেন এখানে পিছিয়ে গিয়েছে। আরিশা দাঁড়িয়ে আছে ঠিকই। তবে এই আরিশা, সেই ছোট্ট বেলার আরিশা। হলুদ প্রজাপতির মত ফ্রক পরা, মাথায় করে নেওয়া আদুরে পনি টেইলটা কি সুন্দর ওপর নীচ করছে। দুষ্টুমি ভরা চোখে খেলছে হাসির ঢেউ। ছোট্ট পুতুলটা তাকিয়ে আছে ওর বাবার দিকে। বাবার হাত দুটো সামনের দিকে প্রসারিত। তাকে আরও প্রসারিত করে বাবা আলতো করে ডাক দিলেন “আয়”। সেই ডাকে চঞ্চল পদক্ষেপ পিছু হটে কিছুটা, এরপর এক পা, দু পা করে এগিয়ে গিয়ে একদম সোজা দৌড়ে উঠে পড়ে বাবার কোলে। বাবা দু হাতে ওকে লুফে নিয়ে শূণ্য ছুঁড়ে দেয়, আবারও খপ করে ধরে নেয় নিজের বলিষ্ঠ মুষ্ঠিতে। আরিশা যেন খুব মজা পাচ্ছে খেলাটাতে। বাবার কোলে দোল খেতে খেতে ও খিলখিল করে হাসছে। নিজের হর্ষ কলতান নূপূরের মিষ্টি ছন্দের মত কানে এসে বাজে আরিশার। পাখির কন্ঠে ওঠা তীক্ষ সুরের মত সেটি ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। কেমন এক শূণ্যতার বলয় যেন জেগেছে নিজের চারপাশে। নিজের সত্ত্বার সঙ্গে দূরত্ব মেপে নেওয়া কষ্টের এটা জানা ছিল, তবে সেটা যে এতটাই কষ্টের তা আজ বুঝা গেল। আরিশার দু’চোখ বেয়ে এখন সরু হয়ে অশ্রু ধারা গড়িয়ে পড়ছে। ঐ তো, আরিশা আবারও পাখির পালকের মত শূণ্য থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসছে বাবার কোলে। ওর কানে গম গম করে আঁছড়ে এসে পড়ছে বাবার সেই জাদুকরী কন্ঠ
“তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে….”

Related Posts

Leave a Comment