আজ কতদিন হইল বেশ গরম অনুভূত হইতেছে। গত কাল হইতে আবার বাতাস কাটিতেছিল বেশ। কেমন যেন একটু শীত শীত ভাবও জাগিয়া উঠিয়াছে। কিন্তু অবাক করিবার বিষয়, কোন শীত বস্ত্র শরীরে চাপানো যাইতেছে না। চতুর্দিকে কেমন এক অস্থির গুমোট ভাব। মনে হয়, চারিপাশটা বুঝি থমথম করিতেছে। আমাদের কোয়ার্টারের সন্মুখে যে ঝাঁকড়া গাছটা দাঁড়াইয়া রহিয়াছে তাহার পত্র পল্লবেও আলাপ জাগিয়াছে শনশন। প্রায় এক মাস হইতে চলিল এই দেশে আসিয়াছি। তবুও কেন জানি না এখন অবধি ধাতস্থ হইয়া উঠিতে পারিতেছিনা। ঠিক কতদিন যে সমুদ্র পাড়ি দিয়া এই বঙ্গ দেশে আসিয়া পৌঁছাইয়াছিলাম, তাহার কোন রূপ সঠিক হিসেব আসলেই নেই আমার। সমুদ্রের বিশাল বিশাল ঢেউ আর রাক্ষুসে বাতাসের দাপটকে সঙ্গী করিয়া দিবা রাত্রি কেবলই ঈশ্বরকে ডাকিয়া গিয়াছি। একবার তো নিদারুণ ঝড়ের কবলেই পড়িয়াছিলাম। ঈশ্বরের কৃপা আর ক্যাপ্তানের দূরদর্শীতায় সেই যাত্রায় অবশেষে প্রাণ ফিরিয়া পাইলাম। কলিকাতা বন্দরে নোঙর করিলে পরে স্বস্তি মিলিল চিত্তে। জেসাস! এই খানে পা রাখিতেই চমক! এ কোন পৃথিবী! এত এত পার্থক্য কি একই পৃথিবীতে সম্ভব, কখনও? জনসন ওখানেই ছিল আমাকে অভ্যর্থনা জানাইতে। ওর কয়েক দিনের ছুটি মন্জুর করিয়াছিল কোম্পানি। আমাকে বগল দাবা করে নিয়েই ফের ছুট লাগাইল।
এই দেশের সব কিছু কেমন অদ্ভুত! ওদের ভাষা, পোশাক, চাল চলন সব! দিবা রাত্রির হিসেবটাও বড় গোলমেলে। কয়লা চালিত ট্রেনে করিয়া জনসনের কর্মক্ষেত্র আসিতে সময় লাগিয়া গেল বেশ। ভালই বড় সড় বাড়ি। দুইজন মানুষের থাকবার জন্য বোধ করি খানিকটা বাড়াবাড়ি রকমের বড়। চাপরাশি, পাকরাশি, প্রহরী সব মিলাইয়া মোট কতজনা হবে তা আজ অবধি ঠাহর করিয়া উঠিতে পারি নাই। জনসন সারাদিন ব্যস্তই থাকে। রোজ ভোরে সেই যে অশ্বারোহী হয়ে গায়েব হয় এরপর গোটা দিন আর কোন সাক্ষাতই মেলে না।
প্রতি প্রত্যুষে প্রাত: রাশ সমপন্ন করিয়া একটু হাওয়া বদল করিতে বাহির হই। চমৎকার হইয়া থাকে ঐ সময়কার আবহাওয়া। সেইদিন আর্দালী বলিল, এইখানে নাকি এখন গরম কাল চলিতেছে। এই দেশের আবহাওয়াটা বড্ড ভ্যাপসা। শরীরের পোশাকগুলো কেমন আষ্টেপৃষ্টে চাপিয়া বসিয়া পড়ে। দম বন্ধ হইবার উপক্রম যেন। এই রাজ্যের পথঘাটগুলিতে কেমন এক মায়া জড়াইয়া রইয়াছে। মুক্ত বাতাসে মৃত্তিকার ঘ্রাণ উড়িয়া বেড়ায়। কেমন মাদকতা ভরা ওতে। মাটিরও ঘ্রাণ রহিয়াছে? কি বিস্ময়! আমাদের বসতালয়ের বাম পার্শ্ব দিয়া একটা জলা পুকুর নামিয়া গিয়াছে। ওইটার চারিপাশের পাড়টার একদিক ধ্বসিয়া পড়িয়া কেমন ভৌতিক দেখায়। জলাধারের কিনারা জুড়ে বড় বড় সবুজ ঘাস জন্মাইয়াছে। তাহাদের ভেতর হইতে আবার ছোট ছোট হলুদ রঙের ফুল বেড়িয়েছে। দেখিতে বড়ই অনন্য। অনেকটা আমার মাথার হ্যাটে তোলা নকশাটির মত। কাল দেখিতে পাইলাম, ইয়া মোটা সোটা কালো রঙের একটি চতুষ্পদ মনের আনন্দে ঘাস ভক্ষণ করিতেছে। প্রথমে ঘাবড়াইয়া পড়িয়াছিলাম খুব। পরে জুলিয়েন বলিল, উহাকে নাকি ছাগল বলে।
জুলিয়ান আমাদিগর আর্দালীর পুত্র। নিতান্তই তের চৌদ্দ বছরের এক বালক। কুচকুচে কালো গায়ের রঙ। মোটা পুরু ঠোঁট। একদম আমার দোল খাইবার ঝুলনার মতন। তবে দাঁতগুলো ভীষণ নান্দনিক। ফকফকে সাদা একদম। জনসন বলছিল, উহারা নাকি সাঁওতালি। ট্রাইব পিপল। সে যাই হউক, জনসন কাজে চলিয়া গেলে পরে গোটা দিনে এই জুলিয়ানই আমার সাথী। সেইদিন তো বড্ড আনন্দ হইয়াছে। বাড়ির পেছনে কি যেন এক ঝোপা গাছ রহিয়াছে। জুলিয়ান বলিয়াছিল অবশ্য নামটা; এখন আর স্মরণে আসিতেছে না। গাছ ভরা সাদা সাদা ফুল। একদম আমার পছন্দের ইয়ার রিংগুলোর ন্যায়। জুলিয়ানের কথা মত ঐ গাছটিতে ঝাঁকুনি দিতেই কি জাদু! রাশি রাশি ফুল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল নীচে। কতক্ষণের মাঝেই মাটির ওপরে একদম এক সফেদ কার্পেট বুঝি বিছাইয়া পড়িল। জুলিয়ান মনের আনন্দে কুড়াইয়া যাইতেছিল ঐসব। আমিও বেশ উপভোগ করিতেছিলাম। আচমকা হাতের আঙুলে কেউ যেন বিষ মাখানো সূঁচ ফুটাইয়া লইল। আমি আর্তনাদ করিতেই জুলিয়ান দৌড়াইয়া আসিল। কুতকুতে চোখ দিয়ে আমার আঙুল পরখে লইল গভীর ভাবে। ক্ষতস্থানটি ততক্ষণে ফুলে উঠিয়াছিল বেশ। ভয়ে ভয়ে গাছটির কান্ডের দিকে চোখ ফেলিতেই নজরে আসিল, কতক থোকা থোকা লাল বর্ণের বড় বড় কীট ঘুরিতেছে। এইসমস্তকে নাকি পিঁপড়ে বলে। এহেন কীটের কামড়ে এত্ত যন্ত্রণা হয় জানা ছিল না সত্যি! ইতিমধ্যে জুলিয়ান কোথা হইতে কতক ঘাস আর লতাগুল্ম ছিড়িয়া নিয়া আসিয়াছে। সেইগুলিকে পাথরের ওপর পিষিয়া তার নির্যাস আমার হাতে লাগাইয়া দিতেই কতক্ষণের মাঝেই অবাক কান্ড! জ্বালা আর যন্ত্রণা উভয়ই কমিয়া আসিল। বাস্তবেই, এই রাজ্যের পরতে পরতে যেন জাদু খেলিয়া বেড়ায়। এই অবহেলিত বন্য গাছপালার মাঝেও প্রতিষেধক লুকাইয়া রইয়াছে। আশ্চর্য বটে!
আজ আবার এক ভীষণ কান্ড ঘটিয়াছিল। আজ ঘুরিতে ঘুরিতে কতক বেশি দূরত্বেই চলিয়া গিয়াছিলাম। জুলিয়ান আর আমি মিলিয়া গাছ হইতে আম্র পাড়িয়াছি। নুড়ি দিয়া ঢিল ছুঁড়িয়া এই খেলাটা খেলিতে মনে বড় পুলক পাইতেছিলাম। “আম্র” এদেশীয় এক প্রকারের ফল। ছিড়িয়া লইলে এগুলোর গা হইতে দুধের মতন এক প্রকার সাদা কষ বাহির হয়। স্বাদেও টকটক। তবে আমার খাইতে বেশ লাগিয়াছে। জুলিয়ান বলিল, এইগুলো পাকার পর নাকি অনেক সুমিষ্ট হয়। আর তখন দেখিতেও হলুদাভ দেখায়। আমি আবারও আশ্চর্য হই! এমন বৈচিত্রময় ফল আমাদের ব্রিটেনে কখনই নজরে আসে নাই। বেশ উপভোগ্য হইয়া উঠিয়াছিল সময়টা। তবে ঘটনাটা ঘটল এরপরই। আচমকা উত্তর পূর্ব আসমানে কালো মেঘের স্তুপ জড়ো হইতে লাগিল। আমি হতবাক হইয়া দেখিলাম, চারিদিকের পরিবেশ কেমন হঠাৎ পরিবর্তন হইয়া গেল। ক্রমে মেঘের আকৃতি বিরাট হইয়া উঠিল। অম্বুরাজির এই অবয়ব আমার খুব পরিচিত লাগিল। হ্যাঁ। স্মরণে পড়িয়াছে। আমাদের রেসের মাঠের দশ নম্বর ঘরের ডার্বি ঘোড়াটার মতন। ভীষণ তেজী অশ্ব সে। হঠাৎই শোঁ শোঁ বাতাস বইতে আরাম্ভ করিল। প্রথমে ধীরে এরপর ভয়াল রূপে তার ক্রোধ বর্ষণ করিতে শুরু করিল। আমি প্রকৃতির এমন ভয়াল রূপ কখনোই দেখি নাই। আনমনে কপালে বুকে ক্রুশ আঁকিয়া নেই। জুলিয়ান বেশ ভীত হইয়া পড়িয়াছিল। সেইটা বুঝি বা আমারই জন্যে। আমরা দ্রুত একটা ভাঙা পরিত্যক্ত কুটিরে আশ্রয় লই। আশপাশ একদম জন শূণ্য। যেন কোন অভিশপ্ত প্রেতপুরীতে আমরাই কেবল জীবিত কোন অস্তিত্ব। দুই জনাই হালকা হাসি দিয়া পরস্পরকে সাহস যুগাইয়া লইলাম। ঝড়ের বেগ বাড়িয়াই চলছিল। দৃষ্টির সন্মুখে জল আর ধূলিকনার আবরণে সব অস্পষ্ট লাগিতেছিল। মাথার ওপর ছাতার ন্যায় মেলে থাকা শূণ্যের বক্ষে কি এক কুরুক্ষেত্র শুরু হইয়া গিয়াছিল। মনে হইল গ্রীক বীর আলেকজান্ডার আর ইরানের সম্রাট দারিয়ুসের সেই পৌরাণিক যুদ্ধই বুঝি দেখিতে পাইতেছি। বিকট কড়কড় শব্দে কোথা যেন বাজ পড়িল। আর সেই মুহুর্তে আকাশের বুক চিড়িয়া আমি এক আলোর ঝলকানি দেখিতে পাইলাম। সহসা দুই হাতে কান চাপা দিয়া লই। সমুদ্র ঝড়ের সেইদিনের ভয়াল স্মৃতি ফের তাজা হইয়া উঠিল যেন। হঠাৎ দেখিলাম চোখের সামনেই একটি বৃক্ষ সমূলে উৎপাটিত হইয়া পড়িল। হায় ঈশ্বর! এই সব কি হইতেছে জানি না! কি সর্বনাশা প্রলংকয়ী তান্ডব। মনে মনে আবার জেসাস কে ডাকিতে লাগিলাম। জলের সীমানা কেবল বেড়েই চলিতেছিল। কতক্ষণ এইভাবে অতিবাহিত হইয়াছিল বলিতে পারিব না। অবশেষে এক সময় বুঝি ঈশ্বরের ক্রোধ কমিল। ধীরে চারিদিকে ফর্সা আলো ছড়াইতে শুরু করিলে আর এক মুহুর্ত কালক্ষেপণ না করিয়া জুলিয়ানকে নিয়া ডেরার দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলাম। কিভাবে আসিয়া পৌঁছাইয়াছি সেই এক রহস্যের বিষয়। আসিবার পর দেখিলাম সকলের মুখমন্ডল দুশ্চিন্তায় একদম ফ্যাকাশে হইয়া পড়িয়াছে। আমাদের দেখিয়া সকলের ধড়ে বুঝি প্রাণ ফিরিয়া আসিল। অল্প কতক্ষণ পর জনসনের ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ শুনিয়া সচকিত হই। বেচারাও বুঝি আমাকে লইয়া ভাবুক হইয়া উঠিয়াছিল। জনসনকে দেখা মাত্রই ওর বক্ষে ঝাঁপিয়া পড়িলাম। দুই জনেই দুই জনার উষ্ণ বাহুডোরে আবদ্ধ থাকিলাম বহুক্ষণ। ক্ষণিকের জন্য আজ চিত্তে প্রিয়জনকে চিরতরে হারাইবার ভয় জাগিয়াছিল। জুলিয়ানের হাত তালির শব্দে উভয়ই যেন সম্বিত ফিরিয়া পাইলাম। জুলিয়ানের দিকে চোখ পাকাইয়া নিতেই কোথা যে পলায়ন করিল কে জানে? খুব বিচ্ছু ছোকড়াটা।
এখন রাত। ঘড়িতে আট বাজিল। কেমন গা ছমছম করা শব্দ। অনেকটা আমাদের গ্রেভ ইয়ার্ডের সামনে থাকা চার্চের ঘন্টা ধ্বনির মতন। আমার আবার ভূতের ভয় বিস্তর। ইংল্যান্ডের ঝড় বৃষ্টি অর্থই কিন্চিৎ সুখ স্পর্শ। অথচ এর যে এত ভয়াল রূপ রহিয়াছে এইখানে না আসিলে তা অজানাই থাকিয়া যাইত। আজ শরীরটা খুব দুর্বল অনুভূত হইতেছে। এখন অবশ্য নিজেকে কিছুটা সামলাইয়া লইয়াছি। তবে বিশ্রামের জন্য দেহ আঁকুপাঁকু করিতেছে। আজ আর কলম চলিতেছে না। থাক তবে। বাকি কথা না হয় কাল লিখিব।
আর হ্যাঁ! সবার কাছ হইতে জানিতে পারিলাম, এই ঝড়কে নাকি এইখানে “কালবৈশাখী” ঝড় বলে। এই রূপ ভয়াল ঝড় যে কেবল সাগরেই নয়, ডাঙাতেও সংঘটিত হইয়া থাকে তা আজ জানিলাম।সত্যি! বঙ্গদেশ আসলেই বড় বিচিত্র।
অ্যানা গোমেজ
১৮ই এপ্রিল, ১৮৩৭
বঙ্গদেশ, ভারতবর্ষ