মে দিবস- জন্ম, এক অদম্য সাহসী গাঁথার

by soniatasnim

“Eight hours for work, eight hours for rest, eight hours for what we will.”

এই স্লোগানকে প্রতিপাদ্য করে জ্ন্ম নিয়েছিল “আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার”। যার উদ্দেশ্য ছিল কেবল শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি এবং অধিকার আদায় করে নেওয়া। শুনলে অবাক হতে হবে, এটাই সত্য যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারাম্ভে সভ্যতা গড়বার এসব সাহসী সৈনিকেরা তাদের কায়িক শ্রমের বিনিময়ে প্রাপ্য মজুরীটুকু সঠিক ভাবে তো পেতই না উপোরন্তু তারা এক প্রকার ক্রীতদাস হিসেবে পরিগণিত হত। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, দিনের চব্বিশ ঘন্টার মাঝে বারো ঘন্টাই তাদের কর্ম ঘন্টা বলে বিবেচিত হত। আর তাই এমন অনাচারের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৬০ সালে শ্রমিকেরা তাদের মজুরি না কমিয়ে সারাদিনে আট ঘন্টা কাজের সময় নির্ধারনের জোর দাবী জানায় এবং এই দাবীর বীজ থেকেই অঙ্কুরোদগম ঘটে মহান মে দিবসের।

দৈনিক আট ঘন্টা কাজের দাবীতে ১৮৮৪ সালে একদল শ্রমিক তাদের এই দাবী কার্যকরের জন্য সময় বেঁধে দেয় ১৮৮৬ সালের ১লা মে পর্যন্ত। বারবার তারা মালিক পক্ষের দরজায় ধর্ণা দিয়েও কোন সাড়া মেলেনি এ ব্যাপারে। ইতিমধ্যে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত এক আর্টিকেল এই বিদ্রোহের অনলের জ্বালানি হিসেবে কাজ করে। আর তাতে শিকাগো হয়ে ওঠে প্রতিবাদ বিদ্রোহের মূল বেদী।

মালিক বণিক শ্রেণী শুরু থেকেই শ্রমিকদের দাবীর বিপক্ষে ছিল। ফলে পহেলা মে যতই এগিয়ে আসছিল সংকটের কালো মেঘ আরও ঘনীভূত হচ্ছিল। পুলিশ বাহিনীকে শ্রমিকদের পিছনে হিংস্র হায়নার মত লেলিয়ে দিতে বিশেষ অস্ত্র কিনে দিয়েছিল ব্যবসায়ীরা। যার ফলশ্রুতিতে, পহেলা মে তে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় তিন লাখ শ্রমিক কাজ ফেলে রাস্তায় নেমে আসে। আন্দোলনের বারদ হয় আকাশ চুম্বী।

৪ঠা মে ১৮৮৬ সালের এক বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যে বেলা। ঘড়ির কাঁটা তখন ছুঁয়ে নিয়েছে সাড়ে সাতটার ঘর। হালকা হিমেল হাওয়ার আলোয়ান শরীরে মুড়িয়ে নিয়ে শিকাগোর হে- মার্কেট স্কোয়ার নামক এক বাণিজ্যিক এলাকার চরণতলে প্রতিবাদী সব শ্রমিকেরা সমবেত হন এক মিছিলের উদ্দেশ্যে। যার মূল প্রেরণা ছিল ১৮৭২ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত সেই সাফল্যমন্ডিত শোভা যাত্রা। শ্রমিক দলের যোগ্য কান্ডারী অগাস্ট স্পীজ তখন সমবেত শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বুলেট ভাষণ দিচ্ছিলেন। আচমকা দূরে দাঁড়ানো পুলিশ দলের কাছে এক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় তৎক্ষনাৎ ভাবে মেথিয়াস. জে. ডিগান নামক একজন আইন রক্ষী বাহিনী এবং স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আরও ছয়জন নিহত হন। এবং ফলশ্রুতিতে পুলিশ বাহিনী শ্রমিক দলের ওপর অতর্কিত আক্রমণ শুরু করলে মুহুর্তেই তা দাঙায় রূপ নিয়ে বারুদ স্ফুলিঙ্গের মত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই রায়টে শহীদ হন মোট ১১ জন শ্রমিক।

পরবর্তীতে, পুলিশের পক্ষ থেকে অগাস্ট স্পীজ সহ মোট আট জনকে শ্রমিক হত্যাকান্ডে দোষী সাব্যস্ত করে এক প্রহসন মূলক হত্যা মামলা সাজানো হয়। গ্রেফতারকৃতদের মাঝে অস্কার নীবে কে ১৫ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। তারচাইতেও বড় নাটকীয় ব্যাপার হল, ফাঁসি দেবার পূর্বেই কারারূদ্ধ থাকা অবস্থায় লুইস কিং নামক একজন রহস্যজনক ভাবে আত্মহত্যা করে বসেন। আর বাকি ৬ জনকে ১৮৮৭ সালের ১১ ই নভেম্বর তারিখে উন্মুক্ত স্থানে ফাঁসি দেওয়া হয়।

ফাঁসির দড়িতে ঝুলে যাবার আগে অগাস্ট স্পীজ তাঁর যেই অমোঘ কথাটি বলেছিলেন তা যেন যুগে যুগে কোটি কোটি শ্রমিকদের কোরাস কন্ঠে উচ্চারিত হয়ে আসছে

“ The day will come when our silence will be more powerful than the voices you are throtting today.”

আরেক বিপ্লবী নেতা আলবার্ট পারসন্স এর শ্বাস রোধ হয়ে যাবার মুহুর্তে যে অব্যক্ত কথাটি রয়ে গিয়েছিল তাকে পূর্ণতা দিতেই বুঝি আজও বিশ্বের কোটি কোটি শ্রমিক সগৌরবে সংগ্রাম করে যাচ্ছে

“ Let the voices of people be heard…”

কথায় আছে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। হলোও তাই।১৮৯৩ সালের ২৬ শে জুন ইলিনয়ের গভর্নর জন পিটার অল্টগেল্ড এর পক্ষ থেকে বলা হয়, ঐদিনের বিচার ছিল মিথ্যে এবং প্রহসনমূলক। আর এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্য দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা পুলিশ কমান্ডারকে। আর এমন করেই পহেলা মে কে শ্রমিকদের আত্মদান আর দাবী আদায়ের দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেবার প্রক্রিয়ার গতি আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়। পরিশেষে, পোক্ত ভাবে মে দিবস আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় ১৯০৪ সালে। সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল প্রতিনিধিদের ষষ্ঠ কংগ্রেসের আয়োজন করা হয় ঐ বছরের ১৪ থেকে ১৮ই আগস্ট। অ্যামাস্টাডামে অনুষ্ঠিত এই কংগ্রেসটি দ্য ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কংগ্রেস হিসেবে পরিচিতি পায়। এতে অংশ নেয় ইউরোপের সকল দেশের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক রাজনৈতিক দল ও শ্রমিক সংগঠণগুলো। সেই দিনই আইনের মাধ্যমে শ্রমিকদের জন্য একদিনে সর্বোচ্চ কর্ম ঘন্টা আট ঘন্টা প্রতিষ্ঠা করবার আহ্ববান জানানো হয়। জন্ম নেয় শ্রমিক দিবস।

১৮৯৩ সালে শিকাগোর ফরেস্ট পার্কে জার্মান ওয়েল্ডহেইম কবরস্থানে চির নিদ্রায় শায়িত শহীদ পাঁচ জন শ্রমিকের (ফিল্ডেন ব্যতীত)। স্মরণে গ্রানাইটের তৈরী ১৬ ফুট একটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। যাতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে একজন পতিত শ্রমিককে ধরে রেখেছে বিচারের প্রতিনিধিত্বকারী এক নারী। আর এর পাদদেশে খোদিত করা রয়েছে অগাস্ট স্পীজের সেই সর্বশেষ উক্তিটি। স্তম্ভের পেছনে রয়েছে গভর্নর অল্টগেল্ডের একটি ব্রোঞ্জের ফলক, যা কিনা তার ন্যায়বিচারের প্রতীক বহন করে চলেছে।

মজার ব্যাপার হল, এখানে একটা কথা না বললেই নয় যে, এই মে দিবসের উদযাপনের ইতিহাস কিন্তু আরও পুরোনো। কেবল এর ব্যাপ্তীর সীমানা ছড়িয়েছে বহুদূর পর্যন্ত। এটি একারণেই বলা যে, এই শ্রমিক দিবসের আর্বিভাবের আগে ব্রিটিশরা বিশ্বাস করত, এই দিনটি বছরকে আলো আর আঁধার এই দু ভাগে ভাগ করে থাকে। আর সেই কারণে তারা এই দিন পালন করত বেলট্যান উৎসব হিসেবে। আর পরবর্তীতে রোমানরা এই দিবসটিকে ফুলের দেবীকে উৎসর্গ করে উদযাপন করত ফ্লোরালিয়া। তবে এসব যাই হোক না কেন, ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই দিবসটি আর কোন নির্দিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে পৃথিবীর সমস্ত শ্রমিক কূলের অদম্য সাহস আর যুগান্তকারী এক প্রতিবাদের স্বীকৃতি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। বছরের পর বছর ধরে এমন করেই গোটা পৃথিবী সশ্রদ্ধ চিত্তে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে যাচ্ছে সভ্যতা গড়বার এসব দু:সাহসী কারিগরদের। হ্যাঁ। ঠিক এভাবেই সাহসী নির্ভীক এই শ্রমজীবীদের সম্মান প্রদাণ করবার তরে যুগে যুগে এই মহান মে দিবস সগর্বে পালিত হয়ে আসছে।

তথ্যসূত্র: পত্রপত্রিকা, বই পুস্তক, ইন্টারনেট

Related Posts

Leave a Comment