কমলাপুর রেলস্টেশনের রেললাইনের কিনারা ঘেঁষে ছাপড়া বস্তির সাড়ি।লাইন ধরে থরে থরে দাঁড়িয়ে রয়েছে দারিদ্রের নির্মম প্রহসনের মূর্তির নির্মম বাস্তব আলেখ্য।চাঁদের রূপালি আলোতে চাতালের ওপর মেলে রাখা নীলচে পলিথিনের আস্তরগুলো কেমন কালচে দেখাচ্ছে।কিছুক্ষণ আগের বিষন্ন বাদল স্নাত রাত্রি এখন দুধেল জোৎস্না গায়ে মেখে এক আবেদনময়ী চরিত্রে নিজেকে পাল্টে নিয়েছে।আসলেই প্রকৃতি বড় বিচিত্র হয়।এই মাত্র যে রূপের রাণী সেজে উঠেছে কোন রকম কার্পণ্য ছাড়াই তো পরমুহূর্তেই তার জন্য রাক্ষসী হয়ে ওঠা যেন মোটেও বিচিত্র কিছু নয়।মানুষের সাথে প্রকৃতির ঠিক এই বিষয়টিতে কোন না কোন ভাবে যেন একটা সূক্ষ মেলবন্ধন খুঁজে পাওয়া যায়।যে মানুষটি এই মাত্র অমায়িক চেতনার এক মূর্ত প্রতীক তো স্বার্থের খাতিরে সে ততটাই বিপরীত চরিত্রের ছাঁচে নিজেকে ঢেলে নিতে যেন মোটেও অপ্রস্তুত হয় না কখনও।সত্যি এ যেন মুখোশ মুখোশ খেলা।
সদ্য ঝড়ে পড়া বারি ধারা চোরা জলাবদ্ধতা তৈরী করে নিয়েছে পিচ ঢালা রাস্তার মাঝে অনাকাঙ্খিত ভাবে চেপে বসা ভাঙাচোড়া গর্ত গুলির মাঝে।মসৃণতার মাঝে অমসৃনতার এই উপস্থিতিগুলি কেমন যেন উপহাসের ভঙ্গিতে মূর্তমান হয়ে উঠছে থেকে থেকে।
সরল রেললাইনের ধার ধরে আনমনে এগিয়ে চলেছে এক আনমনা যুবক।যুবকের হাঁটার গতি উদ্ধত।গায়ে আলোয়ান প্যাঁচানো সেই যুবকের চোখে মুখে এক অদ্ভুত ধরনের কাঠিণ্য।এক সময়ের স্বপ্নীল চোখ জোড়াতে এখন কোন স্বপ্ন কণা নেই।বদলে রয়েছে বাস্তবতার নির্মম প্রহসন।যুবক হেঁটে যায়।চলার গতি যেন বেড়ে যায় কিছুটা।বিপরীত সমীরণের আলতো ছোঁয়া খেলা করে তার অপরিপাটি চুলের বিন্যাসে।যুবক হাত চালিয়ে সেই নেয় সেই অবাধ্য ঘন চুলের মাঝে।যুবকের কপালে জমে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।যুবকের চন্চল পদযুগলে সজ্জিত পাদুকা জোড়াও বিদ্রোহ ঘোষণা করে আচমকা।যুবক থেমে যায়।দৃষ্টি নত করে নেয়।এত দিনের চলার পথে সঙ্গ দেওয়া তলি ক্ষয়ে যাওয়া স্যান্ডেলের জীবনাবসান ঘটলও আজকের এই মায়াবী রাতে।যুবকের চোখে এখন আক্ষেপ।ক্রোধানল দাউ দাউ করে জ্বলছে চোখের দুটি তারাতে।হতাশার সাগরে ডুবে যাওয়া এক ক্লান্ত সাঁতারু আজ কোন অবলম্বন পায় না তরঙ্গের ওপর নিজেকে ভাসিয়ে নেবার।ক্ষুদ্ধ তরুণ পা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় চটি জোড়া।উদ্বাস্তুদের মতই তারা হারিয়ে যায় কোন অন্ধকারের অতল গহ্ববরে।
যুবক থেমে যায় না।নগ্ন পায়েই এগিয়ে যায় আরও খানিকটা।দমকা বাতাস তার চোখে মুখে ঝাপটা দিয়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।এই মায়াবী চন্দ্রালোক,বাতাসের গান আর নীরব রাতের নিস্তবদ্ধতাও যেন কেমন অস্বস্তির উদ্রেক করছে মনে।আজ হৃদয়ে জেগে উঠছে না কোন সুর কোন ছন্দ।সেতারে সেজে ওঠা সুরের মাতাল ছন্দে আজ যেন ছন্দপতন ঘটেছে।যুবকের চোখে এখন জেগে উঠেছে হতাশা।অবিশ্বাসের কালো মেঘে ঢেকে গেছে তার হৃদয়ের সুনীল শান্ত আকাশ।
আজ অগোছাল যুবকের প্রিয় মানুষটি চিরতরে পর হয়ে গেছে।হারিয়ে গেছে সময়ের আবর্তে।যুবকের ভালবাসার জীবনে অতীত অধ্যায়ের জন্ম হল আজ।না।কারও দোষ নেই কোন।মানুষটিকে পর করেছে যুবক নিজেই।দারিদ্র আর নিষ্পেষণ যার জীবনের নিত্য সঙ্গী সেকথা জেনেও যে নিজের জীবনের সাথে আরেকটি জীবনকে বেঁধে নেবার মত অন্যায় করেছিল তার তো এমনই শাস্তি হওয়া উচিত।এমন ছিন্নমূল আগাছাদের বেঁচে থাকাটাই যেখানে অপরাধ সেই জায়গায় কাউকে ভালবেসে ফেলার মত ধৃষ্টতা দেখানো আর যাই হোক তাকে কোন ক্রমেই মানায় না।
হ্যাঁ।উদ্ধত যুবক দেখিয়েছিল সেই ধৃষ্টতা।কাউকে ভালবেসেছিল তার বাউলা মন।স্বপ্ন দেখেছিল এক অন্য পৃথিবীর।কিন্তু নিয়তির রায় যে বড় নির্মম! নিষ্ঠুর! কদাকার বাস্তবতা তার চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই হয়।তার চেয়ে বেশি কিছু নয়।
ভালবাসার মানুষটা কেঁদেছে।বার বার আছড়ে পড়েছে তার দ্বারে।নিরুদ্দেশ হতে চেয়েছে তার মত এই ছন্নছাড়া বাউন্ডুলে ছেলেটার সাথে।হাতে হাত রেখে প্রমাণ করতে চেয়েছে তার আবেগে কোন খাদ ছিল না।কিন্তু নির্বোধ যুবক তা দেয় নি।সত্যি তো সে এতটা নির্বোধ তা সে জানত না এতদিন।না।একে বোকামি বলে না।
যুবক মনে মনে শংকিত হয়।যে চোখে আজ তার প্রতি এত অনুরাগের জোয়ার কঠিণ দুনিয়ার রুদ্র মূর্তির সন্মুখে তা একদিন ভেঙে যেত ঠিক।তখন সেখানে আর খেলত না কোন আবেগ।কোন প্রেম।উপহাস আর ঘৃণার অনলে পুড়তে হত তখন প্রতিনিয়ত।সেই দৃষ্টির সামনা করার সাহস এই উদ্ধত যুবকের নেই।কোনভাবেই নেই।তাইতো পরাজিত হতভাগ্যদের মত রাত্রির নিকষ আঁধারে নিজেকে লুকিয়ে নিয়েছে দ্রুত।তবে কি ও কাপুরুষ? নি:শ্বাস ফেলে যুবক।ভাবে,হলেও বা কি বা এসে যায়।
ট্রেনের তীক্ষ হুইসেল শোনা যায় হঠাৎ।শোনা যায় শুনসান রাতের নিস্তবদ্ধতা ভঙ্গের তীব্র আর্তনাদ।আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয় সহসা।যুবকের পায়ের গতি থেমে যায়।মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছায়ামূর্তির সামনে দিয়ে রেলগাড়িটা দূর্বার গতিতে অদৃশ্য হয়ে যায়।আবারও সব চুপ।রাত চিড়ে শোনা যায় কোন ক্ষ্যাপা পাখির ডাক।যুবক দৃষ্টি ফেরায়।ট্রেনের অল্প কিছু অংশ নজরে আসে।সে ছুটছে তার পরের স্টেশানে।ভবঘুরে এই যুবককেও এখন খুঁজে নিতে হবে তার জীবনের পরের স্টেশান।
সমান্তরাল রেললাইনের ধারে ক্লান্ত যুবক বসে পড়ে।আবারও উদাসী চুলে চালিয়ে নেয় আঙুলের সন্চালন।আনত মুখে উপরে চোখ তুলে নেয় সে।মধ্য গগণে অংশু এখন প্রকট ভাবে মূর্তমান।শশাংকের মনোহর রূপালি আলোতে নিজেকে ভিজিয়ে নিতে থাকে যুবক।তার দৃষ্টি এখনও উর্ধ্বমুখী।সেই মোহনীয় আলোতে চিকচিক করছে তার চোখ দুটি।আচমকা তার সন্মুখে ভেসে ওঠে প্রিয় মানুষটির মুখ।যুবক হাত বাড়িয়ে দেয়।তার হাত স্পর্শ করতে পারে না সেই অতল দূরত্বকে।প্রিয় মুখটি ক্রমশই অদৃশ্য হতে থাকে মেঘের আড়ালে।যুবক হাত নামিয়ে নেয়।সন্মুখে কেবলই মেঘ আর মেঘ!
যুবকের স্বপ্নীল চোখ দুটিতে আবারও ভাষা বদলেছে।তাতে বেদনার নীল রং দেখা দিচ্ছে স্পষ্ট।যুবকের চোখের কোল ভিজে ওঠে।হাত দিয়ে সেই নোনা জল সরিয়ে নেয় সে।আবারও কঠোর হয়ে যায় সেই তামাটে বর্ণের ক্ষ্যাপা মুখাবয়ব।সেই মুখে কোন প্রেম নেই।আছে শূণ্যতা আর কিছু প্রশ্ন।যাদের উত্তর মিলবে না কোনদিনও।নাহ!আর না।উদ্ধত যুবক আর কক্ষণো কাঁদবে না।
কাপুরুষদের কাঁদতে নেই।