বর্ষবরণ

by soniatasnim
নিকষ রাত্রি তার কৃষ্ণ কাজল দানি মেলে ধরেছে অকপটে। সেই মায়াবী নিশির ঘন তমসার নি:স্তব্ধতা খান খান হয়ে ভেঙে যাচ্ছে দুমদাম শব্দে। মাথার ওপর কালো চাদরের মত বিন্যস্ত আকাশের বুকে জরি বুটির মত জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা নীলচে তারা রাজির ঔজ্জ্বল্য ম্লান হয়ে যাচ্ছে ঐ ফুলঝুরির মত ছিটকে পড়া রঙ বেরঙের আতশবাজির জৌলুসের কাছে। গলির মাথাতে যে লাইট পোস্টটা, বার্ধক্যের শাসানিতে জর্জর বৃদ্ধের দুর্বল দৃষ্টির মত টিমটিমে বাতির আলো নিয়ে যেটা বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে দেয় অহরহ, প্রতিদিনের মতই ওটার লম্বাটে আভার নীচে গুটিশুটি মেরে রাত কাটাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে রানা। ওর গায়ে জড়িয়ে থাকা পাতলা সাদাটে যে জামা সেটাও ম্লান অর্চির কল্যাণে হলদেটে দেখাচ্ছে। কচি দু হাতে যতটুকু সাধ্যি বালির স্তুপ সরিয়ে ওখানে সবে পিঠ ফেলেছে ও। আজ দুপুর থেকে রাত অবধি পেটে তেমন কিছু পড়েনি। অতি ক্ষুধার তোড়ে কেমন বিবমিষা ভাব হচ্ছে এখন মাঝে মাঝে। সন্ধ্যের দিকে একটা রেঁস্তোরার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেও তেমন কোন উচ্ছিষ্ট রিজিকে মেলে নি আজ। অগত্যা ভাগ্যের লিখন বলে মেনে নিয়ে নিজের অভুক্ত চিত্তকে বুঝ দিয়েছে কোনমতে। শীতটা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। হাতের বস্তাটা শরীরে বিছিয়ে নিয়ে নিজেকে আরো জড়সর করে নেয় ও। যাক! এবার কিছুটা ওম মিলল কি? চোখ জোড়া ক্লান্তিতে বুজেই আসছিল তো তখুনি এমন বেয়ারা আস্ফালন শুরু। কি ব্যাপার? কোন গন্ডগোল নয় তো? বুঝে উঠতে না উঠতেই ওর চোখের দৃষ্টি চলে যায় সম্মুখে। কজনা কেতাদুরস্ত ছেলেপুলে তাদের হাতে থাকা সরু কাঠিগুলোতে আগুন দিচ্ছিল। আর তা দিতেই আলোর তুবড়ি বান ছুটল বুঝি রুক্ষ পথের পরে। আনন্দে হাত তালি দেয় ওরা। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কি বা একটা বলে নিল সকলে, তা বুঝতে পারে না রানা। আচমকা কাছে দূরে সমস্ত জায়গায় এমন মুর্হুমুর্হু ধ্বনি আর আলোক বিচ্ছুরণের আবেশে আলোকিত থাকে সর্বত্র। রানা চোখ কচলে মুখ ওপরে তুলে নেয়। কি সুন্দর দৃশ্য! অসীমে যেন আজ তারাবাতির সম্রাজ্য জেগেছে। রানা বিস্মিত হয়ে রয়। আচমকা কোথা থেকে একটি বালক পথের সেই ছেলেগুলোর দিকে দৌড়ে চলে যায়। উৎফুল্ল কন্ঠ ওর ভেসে আসে বাতাসে “হ্যাপি নিউ ইয়ার” রানা উৎসুক হয়ে ওঠে। কথাটা আজ কোথায় যেন শুনেছে ও। হ্যাঁ! এই তো, মনে পড়েছে। বিকেলে রবি বলছিল, কাল থেকে নাকি নতুন বছর শুরু। তাই সব বাড়ি বাড়ি আজ অনেক আনন্দ ফুর্তি হবে! দারুণ মজা করবে সকলে। সেজন্যই বুঝি এখন এত সরগোল। সেটাই হবে হয়ত! রানা বড় করে একটা হাই তোলে। ওর বড্ড ঘুম পাচ্ছে। জীর্ণ বস্তাটা পুণরায় গাত্রে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে রাস্তায়। কানে ভেসে আসে ঐ বালকদের চন্চল উচ্ছ্বাসিত কলতান।
রানা আবারও চোখ বুজে নেয়। ওর বন্ধ চোখের ঝাঁপিতে জেগে ওঠে এক স্বপ্ন। কেমন ফ্যাকাশে আর প্রাণহীন সেই ঘোর। তাতে নেই কোন আনন্দচ্ছটা, বদলে আছে একরাশ অনিশ্চয়তার নীল আতংক আর ভীতি। হঠাৎ কুঁকড়ে ওঠে রানা। নাহ! হিমেল হাতিয়ারে ধরাশায়ী হয়ে নয় কোন, এক নিশ্চিত ভবিতব্য আশংকাকে মোকাবিলা করবার ভয়ে। অপোক্ত মস্তিষ্ক ওর এখন মেতেছে এক নতুন হিসেব মিলিয়ে নেবার খেলাতে। আগামীকাল কালের গর্ভ থেকে জন্ম নিতে চলা নতুন এক লগ্ন গাঁথা যে রানার জন্য জন্ম দিতে চলেছে ক্রুর জীবন সংগ্রামের আরও একটি নব অধ্যায়ের।
ছবি: সংগৃহীত

Related Posts

Leave a Comment