জীবন দিনলিপির শ্বেত পত্রগুলো কৃষ্ণ কালির আঁচড়ে ভরে উঠছে অলক্ষ্যে। চড়ুই পাখির চঞ্চল ডানাতে ভর করে ফুড়ুৎ করে শৈশব পেড়িয়ে কৈশোর… এরপর কখন যে যৌবনের নীল আকাশে এসে পড়লাম! আজ অবধি তার রহস্য কুয়াশার মত আবছাই রয়ে গেল। ভূবন ডাঙার সময়ের তরঙ্গ সাঁতরে তরতরিয়ে এগিয়ে চলছে জীবন তরী। এককালের কাজল কালো কেশে ধীরে জেগে উঠছে বারদ শুভ্রতার আল্পনা। আমার ওপরের খোলস ক্রমশ হয়ে উঠছে পরিণত কিন্তু কখনও কখনও মনে হয় মহাকাল বুঝি থেমে রয়েছে সেই আগের জায়গাটিতেই। যেন এখনো কিচ্ছুটি বদলায় নি একদমও। না আমি! না অন্য কোন কিছু! হ্যাঁ। তাইতো! ঐ তো দেখা যাচ্ছে একহারা গড়নের দ্বিতল বাড়িটা। মরচে পড়া গেটের বাইরে বসে ঝিমুচ্ছে দারোয়ান। কিচিরমিচির শব্দ তুলে সর্পিল রাস্তার ওপর ধুলো উড়িয়ে ছুটছে অটোরিক্সা। ওদের গায়ে রং তুলির প্রলেপে বাংলা সিনেমার পোস্টার সেঁটে দিয়েছে কোন নাম না জানা অখ্যাত কোন পটুয়া। হাড় জিরজিরে টোকাইয়ের দল সামনের বিল্ডিংটার গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকা বড়ই গাছে ঢিল ছুঁড়তে ব্যস্ত। অলস পদক্ষেপে রাস্তা মাড়িয়ে চলছে এক হুলো। দূরে এক মুঠো রঙিন স্বপ্ন হাতে নিয়ে একজন বেলুন ওয়ালা বেলুনে কচকচ ছন্দ তুলছে। ওর সাথে থাকা বাঁশের মাচাটাতে বর্ণিল কাগজে তৈরী মৌচাক গুলো মৃদু বাতাসে দুলছে অল্প অল্প। দু হাতে বারান্দার গরাদ পাকড়ে ধরে তাতে মুখ গুঁজে আমি দেখে যাই ওদের। নীল আকাশের গায়ে একটা দুটা চিল উড়ে বেড়ায়। কাপড় শুকাবার রশিতে বসে দোল খাচ্ছে এক শালিক। ঘাড় বেঁকিয়ে এদিক ওদিক কি দেখ নিল বুঝি এরপরই ফুড়ৎ। জায়গাটিতে কেবল শূণ্যতা এখন। বুকের মাঝে কেমন এক হাহাকার জেগে উঠছে বুঝি। মাটিতে বিছিয়ে নেওয়া মাদুরির ওপর হাট করে খুলে রাখা বাংলা বই। পাশেই বাংলা খাতা। নতুন একদম। সকালেই বাবা কিনে দিয়েছে। হালকা সবুজ রঙের ওপর একজন বয়োজেষ্ঠ্য কেমন মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। এনাকে আমি খুব চিনি। বসবার ঘরে যে বইয়ের তাকটা রয়েছে, ওতে সাজিয়ে রাখা বইয়ের মলাটে এনার ছবি ছাপা রয়েছে। কিন্তু সে আবার আমার খাতার মাঝে এল কি করে! আমি আবারও ছবিটা দেখে যাই। কি সুন্দর ওনার চোখ দুটো! যেন ওপরে ঝুলে থাকা ঐ বিশাল অন্তরীক্ষ তার নয়ন যুগলে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে সুন্দর। কোঁকড়ানো সাদা চুলগুলো দু পাট করে আঁচড়ানো, সাগরের ঢেউ এর মত ওরা আঁছড়ে পড়েছে চওড়া কাঁধের ওপর। মুখ ভরা যেন শরতের কাঁশের শুভ্রতা জেগে। জানি না কেন, আমি আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকি ওঁর দিকে। কেমন বিচিত্র এক মোহ জেগে ওঠে মনে। আচমকা বুঝি ঐ ওষ্ঠদ্বয়ে টলটলে জল বিন্দুর মত এক ফোঁটা হাসির ঝিলিক জেগে ওঠে। বাতাসে যেন ভেসে আসে ফিসফাস
– এই যে খোকা, যাবে আমার সাথে?
কোন কথা বের হয় না মুখ দিয়ে। কেবল মাথা নেড়ে শুধোই
– কোথায়?
উত্তর মেলে না কোন। তবে অনুভূত হল, বুঝি আমি ছুটছি এক রাঙা ঘোড়ার পিঠে চেপে। আমার চারপাশে লিলি করছে সবুজের ঢেউ। মাটির গন্ধ উড়ছে বাতাসে। আমি ছুটছি তো ছুটছি। ঘোড়ার ক্ষুরে ধূলো উড়িয়ে অকাতরে পার করে নিচ্ছি চোরাকাঁটাতে ঢাকা জোড়াদীঘির মাঠ! মরা নদীর সোঁতা। কিন্তু একি! আমার সঙ্গে এই পালকি এল কি করে? কে রয়েছে ওতে? আমি উঁকি মেরে দেখবার চেষ্টা করি। চোখে আমার পড়িয়ে নেওয়া কৌতুহলের মায়া কাজল। বেয়ারাদের কাঁধে চেপে পালকি ওপর নিচ ওঠা নামা করছে থরথর। ধীরে সন্ধ্যে নেমে আসছে পটে। রাক্ষুসে এক আঁধারের বলয় যেন গ্রাস করে নিয়ে যেতে চাচ্ছে সব কিছু। কেমন ভয় জাগে চিত্তে। আচমকা ‘হারে রে রে রে রে’ রবে সরগোল শোনা যায় কোন অজানা প্রান্ত থেকে। বেয়ারেদের দল ভয়ে গুটিয়ে পড়ে। ভীরু খরগোশের মত ওরা কাঁপতে থাকে বুঝি। বর্গী এল কি তবে? তলোয়ারের বাট সজোরে পাকড়ে নেই আমি। আচমকা কেমন করে আজও পালকির দু পাল্লা কিঞ্চিৎ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে সামনে। বিস্ময়ে থমকে যাই আমি। মা আমার পালকিতে যে বসে! পদ্মের মত কোমল বদন খানি কেমন বিবর্ণ দেখাচ্ছে। কিন্তু কেন? মা কি আমার ঘাবড়ে গেছে তবে? ভয় কি মা, সঙ্গে রইলে তোমার বীরপুরুষ এই ছেলে। আমার সামনেই আমি আবারও মুচকি হেসে বলি
“আমি আছি ভয় কেন মা কর?”
মা বলে যায়
- যাস নে খোকা ওরে…
আমি বলি
– দেখই না চুপ করে…
আর, ঐ তো! আজ এতকাল পর আবারও সেই ঝাঁকড়া চুলো কানে জবার ফুল গোঁজা বর্গীর দলের দেখা মিলে গেল। বহু কাল আগের সেই কল্পচিত্র আজ আবার দৃষ্টিসম্মুখে নদীর চরের মত জেগে উঠল যেন। সেদিনের মত আজও আমি আবার মুখ তুলে নেই ওপরে। আশ্চর্য! বিস্তৃত সেই গগন যেন আজও একই ভাবে ভেসে যাচ্ছে সেই মায়া দৃষ্টির স্রোতে। মেঘের পর মেঘের স্তর জমে যেন ফুটে উঠেছে সেই মুখ! তাতে মাখানো সেই স্মিত, শান্ত হাসি। আবার বুঝি অনীল নাওয়ে ভেসে আসে ফিসফাস
– ভয় কি, খোকা? বল!
বাতাসের গান পাকড়ে নেই আমি। মুচকি হেসে ফের বলি
“দাঁড়া খবরদার
এক পা আগে আসিস যদি আর
এই চেয়ে দেখ আমার তলোয়ার
টুকরো করে দেব তোদের সেরে…”