সুর, ছন্দের অঙ্কুরোদগম ঘটেছিল পৃথিবীর জন্মলগ্নেই। তাই বোধকরি, সৃষ্টির আদি লগ্নেই জন্ম নিয়েছিল কবিতা। সাহিত্যের সবচাইতে সমৃদ্ধশালী শাখা কবিতা। এর ব্যাপ্তির সীমানাটাও ব্যাপক। বস্তুত কবিতা হল মানব মনের উপলব্ধির ব্যাপার। মনের অলিন্দ প্রকোষ্ঠে জন্ম নেয়া অনুভূতিগুলোর কাব্যিক প্রকাশই কবিতা। গ্রিক শব্দ “Poiesis” যার অর্থ নির্মাণ করা তাকে ইংরেজিতে বলা হয় “Poetry”. এরিস্টটলের “পোয়েটিকস”এ কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করবার চেষ্টা করবার সাথে যুগে যুগে এ বিষয়ে বিস্তর আলোকপাত করা হলেও তথাপি কবিতাকে সঠিক ভাবে সংজ্ঞায়িত করা আজও সম্ভব হয় নি। কবিতার আছে নিজস্ব কিছু ছন্দ, মাত্রা, বিষয়বস্তু আর তাল।কবি হুমায়ুন আজাদ কবিতা সম্পর্কে বলেছেন
“যা পুরোপুরি বুঝে উঠব না, বুকে, ওষ্ঠে, হৃদপিন্ডে রক্তে মেধায় সম্পূর্ণ পাব না। যা আমি অনুপস্থিত হয়ে যাবার পরও রহস্য রয়ে যাবে রক্তের কাছে তাই কবিতা৷”
সুতরাং কবিতার ব্যাপ্তিকে কোন সীমারেখায় বন্দী করা অসম্ভব। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির আদলে এর পরিবর্ধন এবং পরিমার্জন ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে যা সাহিত্যে নতুনত্বর জন্ম দিয়েছে। মরুর বুকে ঝড় তোলা চার পংক্তির রুবাই থেকে শুরু করে ইউরোপ সুন্দরীর বুকে জন্ম নেওয়া চৌদ্দ চরণ এবং চৌদ্দ অক্ষরের জাদুর ছন্দে সাজানো সনেট সব জায়গাতেই এই কাব্যিক প্রকাশের সুললিত ছন্দের জয়জয়কার। কবিতা যেমন প্রেমিক চিত্তের ভাবুক সত্ত্বার প্রকাশ ঘটায় তেমনি জন্ম দেয় মুক্ত চিন্তার বেদীতলে অসংখ্য বিদ্রোহীকে। এর ছন্দমালা কখনও হৃদয়কে যেমন ভাবাবেগে ভাসিয়েছে তো পরক্ষণেই শিখিয়েছে সোচ্চার হতে। এটি প্রকৃতির প্রেমে যেমন প্রাণ মন উদ্বেলিত করে তেমনি পড়ায় সাম্যবাদের পাঠ। এটি ঠিক যেন ছন্দের হাতিয়ার কোন। ব্রিটিশ বড় লাট কার্জন তাই তো ক্বাসিদার ছন্দ ঝংকার থামিয়ে দিয়ে অবরুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন তৎকালীন স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বপ্ন। এছাড়াও সিজো, জাপানি (৫+৭+৫) জাপানি শ্বাসাঘাত মোরাস মিলে জবরদস্ত জাপানি হাইকু কিংবা লিমেরিকের কোলে পালিত সেই যুদ্ধসৈনিকেরা যাদের কন্ঠে বেজে উঠত সেই সুর “Let us come up to Limerick” যা কিনা এক অজানা কবির কন্ঠে সৃষ্টি সেই লিমেরিক! সময়ের দোলাচলে যা তাদের বংশধরদের মুখে মুখে ফিরত! এদের ছন্দ ডিঙিতে অনায়সেই পার করে নেওয়া যায় কাব্যের এই বিশাল সমুদ্র। বর্তমানে কবিতার গর্ভে জন্ম নেওয়া অণুকবিতার কথা তো না বললেই নয়! এ যে ক্ষুদ্রের মাঝে কাব্যের ব্যাপক অসীম ধরে নেওয়া। আসলে কবিতার কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা হয় না। কবিতা মূলত এমন এক শিল্প যেটা হর্ষ আর বিষাদকে মোহনীয় কল্পনার তুলিতে ছন্দের ঝংকারে ফুটিয়ে তোলে। কবিতা মূলতঃ তার নিজের স্বতন্ত্রতায় সমুজ্জ্বল ও ভাস্বর ও উন্মুক্ত। তাই বুঝি দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন “কবিতা দর্শনের চাইতেও বেশি, ইতিহাসের চাইতেও বড়”