জীবনের অর্ধশতক ছুঁয়ে নিতে বাকি ছিল আর মাত্র তিনশ পয়ষট্টি দিনের যাত্রা পথ। কিন্তু হার মেনে নিতে হল তার আগেই। মাত্র ৪৯ বছর বয়সেই এক বৈচিত্রময়, বর্ণিল অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। বাংলা সাহিত্যের বিস্তৃত গগনে পতন হল এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের। বলছিলাম ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্য জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি এবং নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন দত্তের কথা। তাঁর অনবদ্য সব সৃজন এবং সাহিত্যে অমূল্য অবদানের হেতু স্বরূপ তাঁকে বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণের অগ্রদূত বলে দ্ব্যর্থহীন ভাবে স্বীকৃতি প্রদাণ করা হয়েছে।
প্রচন্ড মেধাবী এই কবির ছোট্ট পরিসরের জীবন গাঁথাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কি রূপ মেধা এবং অমূল্য জ্ঞানরাজিতে সমৃদ্ধ ছিল এই ওনার জ্ঞান ভান্ডার। ব্রিটিশ ভারতের যশোর জেলার এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ বংশে রাজ নারায়ণ দত্ত ও তাঁর প্রথমা স্ত্রী জাহ্নবী দেবীর কোল আলো করে এই মহা কবির জন্ম ১৮২৪ সালের ২৫ শে জানুয়ারি। সাগর দাঁড়ির পাঠশালা থেকে অধ্যয়নের সমুদ্র জোয়ার পাড়ি দিয়ে তাঁর সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটে কলকাতার হিন্দু কলেজের উন্মুক্ত বেদীতে। সময়টা তখন ১৮৩৩ সাল। বাংলা, সংস্কৃত ও ফরাসি ভাষায় তিনি পারদর্শী হয়ে উঠেন অত্যন্ত অল্প সময়ের মাঝেই। ১৮৩৪ সালে কলেজের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ইংরেজি নাট্য- বিষয়ক প্রস্তাব আবৃত্তি করে সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হন এই তরুণ প্রতিভা। বরাবর মেধার স্বাক্ষর রেখে চলা এই কবি নারী শিক্ষা বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করে অর্জন করে নিয়েছিলেন স্বর্ণপদক। ইংরেজি সাহিত্য ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। শিক্ষক ডেভিড নেস্টের রিচার্ডসন তাঁর মাঝে কাব্য প্রীতির বীজ বপন করেন। তবে পরবর্তীতে কাব্য প্রীতি হোক কিংবা রিচার্ডসনের পড়ানোর আকর্ষনেই হোক, খ্রীষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে তাঁকে হিন্দু কলেজ ত্যাগ করতে হয় এবং ১৮৪৪ সালে তিনি বিশপ কলেজে ভর্তি হন এবং পরবর্তী মাত্র তিন বছরের মাঝে তিনি ল্যাটিন, গ্রিক, সংস্কৃত ভাষা শিখে নেন দ্রুততার সঙ্গে। তাঁর রচিত কবিতাগুলি তৎকালীন Bengal Spectator, Literary Gleamer, Calcutta Library Gazette এ প্রকাশ পেত।
তিনি ভাগ্যান্বষনে ছুটেছেন বিচিত্র ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত থেকে শুরু করে সুদূর ভার্সাই নগর অবধি। ১৮৪৪ সালে মাদ্রাজে যেয়ে তিনি মেইল অরফ্যান অ্যাসাইলাম স্কুল (১৮৪৮-১৮৫২) পরে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হাই স্কুলে শিক্ষকতা করেন এবং এখানেই তিনি কবি এবং সাংবাদিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। Eurasion, Madras Circulator, Hindu Chronicle প্রভৃতি পত্রিকা সম্পাদনা করবার পাশাপাশি কবি Madras Spectator পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের পদ অলংকৃত করেন। এই মাদ্রাজে অবস্থানকালেই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “The Captive Ladie” (১৮৪৮) এবং দ্বিতীয় গ্রন্থ “Visions Of The Past” প্রকাশিত হয়। যা রীতিমত এক যুগান্তকরী সৃষ্টি কর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়। পরবর্তী ১৮৫৬ সালে পিতৃবিয়োগের পর তিনি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী হেমরিয়েটাকে নিয়ে কলকাতায় আগমন করেন এবং প্রথমে পুলিশ কোর্টের কেরানি ও পরে দোভাষীর কাজে নিযুক্ত হন। এই সময়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লিখা তার অসংখ্য লেখনীর মাধ্যমে তিনি ব্যাপক ভাবে সুপরিচিত হন।
রাম নারায়ন তর্করত্নের রত্নাবলী (১৮৫৮) নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি নাটকের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং পরে কলকাতার পাইক পাড়ার রাজাদের বেলগাছিয়া থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৮৫৮ সালে মহাভারতের দেবযানী যযাতি কাহিনী অবলম্বনে পাশ্চাত্য রীতির ঢঙে রচনা করেন “শর্মিষ্ঠা” নাটকটির। যেটাকে প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটক বলা হয়। ১৮৬০ সালে কবি গ্রিক পুরানের কাহিনীর গর্ভ থেকে জন্ম দেন “পদ্মাবতী” নাটকের।
তাঁর জীবনের প্রথমাংশে তিনি পাশ্চাত্য সাহিত্যর দিকে ঝুঁকে পড়লেও পরবর্তীতে তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী হন। বাংলা সাহিত্যর নানা স্তরকে তিনি অলংকৃত করে তুলেছেন নতুনত্বে। তাঁর রচিত কাব্যগুলো লক্ষ্য করলে নারী বিদ্রোহের এক ছন্দের মাত্রা পরিলক্ষিত হয়। তাঁর কাব্যের প্রধাণ নারী চরিত্রগুলি যেন যুগ যুগ ধরে অবহেলিত, নিষ্পেষিত নারীরা এক একজন প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠে। ১৮৬২ সালে তাঁর রচিত “বীরাঙ্গনা”
কাব্য গ্রন্থটি তার এক উজ্জ্বল প্রমাণ।
তাঁর প্রহসন দুটি রচনা “একেই কি বলে সভ্যতা?”
এবং “বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো,” বাংলা সাহিত্যে করে নিয়েছিল এক অনন্য সংযোজন।
প্রথমটিতে, কবি তৎকালীন ইংরেজী শিক্ষিত তরুণদের উচ্ছৃংখল ও অনাচারকে কটাক্ষ করেন এবং
দ্বিতীয়টিতে, তৎকালীন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের আচার সর্বস্ব ও নীতি ভ্রষ্ট সমাজ পতিদের গোপন লাম্পট্যের কদর্য রূপকে তুলে ধরেন।
১৮৬৩ সালে মাইকেল মধুসূদন প্যারিস যান। সেখানে তিনি বাংলা সাহিত্যে দুটি যুগান্তকারী মাইলফলকের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। প্রথমত, তিনি ইতালিয় কবি পেত্রাকের অনুকরণে বাংলায় সনেট লিখার প্রচলন শুরু করেন। এই সনেট কবিতাগুলি ১৮৬৬ সালে চতুদ্দর্শপদী কবিতাবলী নামে প্রকাশিত হয়।
দ্বিতীয়ত, ভার্সাই থেকে তিনি নিজ মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি শেকড়ের টান অনুভব করেন। যার ফলশ্রুতিতে তাঁর কলমে জন্ম নেয় “বঙ্গভাষা” ও “কপোতাক্ষ নদ” নামক কালজয়ী কবিতা দুটি।
তিনি ইংরেজী কাব্যের অনুকরণে অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করে বাংলা কাব্যকে ছন্দের বাঁধন থেকে মুক্ত করেন। ১৮৬১ সালে রামায়নের কাহিনী নিয়ে এই ছন্দে রচিত হয় তাঁর প্রথম মৌলিক মহাকাব্য “মেঘনাদ বদ” কাব্য, যার অপূর্ব ছন্দ শৈলী তাঁকে মহাকবির মর্যাদায় আসীন করেছে। রামায়নে বর্ণিত অধর্মাচারী, অত্যাচারী ও পাপী রাবণকে একজন দেশপ্রেমিক, বীর যোদ্ধা ও বিশাল শক্তির আধার রূপে চিত্রিত করে তিনি ঊনিশ শতকের বাঙালির নব জাগরণের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে মর্যাদা লাভ করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ভারতবাসীর চিরাচরিত বিশ্বাসের মূলে আঘাত হেনে প্রকৃত সত্য সন্ধান ও দেশপ্রেমের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বাংলা সাহিত্যর জন্য সেটা এক অনন্য, অমূল্য প্রাপ্তি।
“মেঘনাদ বধ কাব্য” নিয়ে কবির জীবনে একটি মজার ঘটনা রয়েছে। একদিন মধুসূদন দত্ত কলকাতার এক বাজারে হাঁটছিলেন। সেই মুহুর্তে তাঁর রচিত “মেঘনাদ বধ” কাব্য তাঁকে সকলের কাছে অত্যন্ত সমাদরের পাত্র করে তুলেছে। একদিন আচমকা তিনি দেখতে পেলেন জনৈক এক দোকানী খুব মনোযোগ দিয়ে কাব্যটি পড়ছে। তিনি কৌতুহলী হয়ে সেইদিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন
– কি পড়ছেন?
দোকানী উত্তর করল
- একটি কাব্য
মধুসূদন মজা করে বললেন
– বাংলা ভাষায় আবার কাব্য!
দোকানী উত্তর করে
- “মেঘনাদ বদ” কাব্য একটি জাতির ভাষাকে গৌরবময় করতে পারে। ও আপনি বুঝবেন না।
অসাধারণ মেধাবী এই কবি ব্যক্তিজীবনে ছিলেন বরাবরই বিলাসী ও অমিতব্যায়ী, যা তাকে বাস্তব জীবনে অর্থনৈতিক দৈন্যতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে নেয়। বিদেশে অবস্থানকালে এমতাবস্থায় একবার তিনি বিদ্যাসাগরের আনুকূল্যে উদ্ধার পান। আর্থিক দুরাবস্থার মাঝেও তিনি সাহিত্য চর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন। হোমারের “ইলিয়াড” অবলম্বনে ১৮৭১ এ তিনি হেক্টর বধ রচনা করেন। ১৮৭৩ এ রচনা করেন তাঁর জীবনের শেষ রচনা “মায়া কানন”। বাংলা ভাষায় তাঁর ১২টি এবং ইংরেজি ভাষায় ৫টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
সংস্কৃত কাব্যের নির্যাস থেকে কাব্যের বিষয় বস্তুর রঙিন নুড়ি আরোহন করে নেওয়া যুগান্তকারী এই কবি পাশ্চাত্য সাহিত্যের আদর্শের আলোকে বাঙালির জীবন দর্শন ও রুচি বোধকে কাব্যে রূপান্তরিত করে বাংলা সাহিত্যে সূচনা করেছিলেন নব যুগের। তাঁর অনন্য অসাধারণ সব সাহিত্য কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে তাঁকে বাংলা সাহিত্যের মধু কবি বলা হয়। এককালে শৌখিন পালকি করে হিন্দু কলেজে যাতায়ত করা মহাকবির শেষ জীবন কেটেছে উত্তর পাড়ার জমিদার ঘরের লাইব্রেরিতে দু:খ, জরা, দারিদ্রতা, অসুস্থতা এবং চিকিৎসাহীন অবস্থায়। ১৮৭৩ সালে ২৯শে জুন জেনারেল হাসপাতালে রিক্ত অবস্থায় বাংলা সাহিত্য জগতের শক্তিশালী এই মধু কবির জীবনাবসান ঘটে।
তথ্যসূত্র: পত্র পত্রিকা, ইন্টারনেট, জার্নাল