তখন মেরুর বুকে সূর্য ডুবতে বসেছে। গ্রীষ্মের বিদায় ঘন্টা বেজে গিয়েছে সজোরে। শোঁ শোঁ করে বইতে শুরু করেছে উত্তুরে হিমেল বাতাস। প্রচন্ড তার আওয়াজ। মনে হয় বুঝি শত শত হিংস্র ঈগল পাখি আক্রমণের জন্য তাদের বিশাল পাখাতে ভর করে উড়ে আসছে। শ্বেত শুভ্র বরফের স্তুপের মাঝে তখন গর্ত করে গুহা বানানোর কাজে মগ্ন এক শ্বেত ভল্লুক। তার সারা শরীরে তুষারের মত তুলতুলে সাদা লোম। বাহারি দেহ আবরনের কারণে সে মেরুর পশু সমাজে বেশ সমাদৃত। রবির ঝলমলে কিরণের কল্যানে কখনও ওকে হালকা বাদামি, সবুজ, হলুদ রঙা দেখায়। আবার কোন কোন সময় মনে হয় নীল আকাশের কিছু আদর পরশ ওর শরীরে লেপ্টে পড়েছে। তীক্ষ নখের আঁচড়ে ভল্লুক একমনে ওর কাজ করে যাচ্ছিল। পাশেই একটা মৃত সীল মাছ পড়ে রয়েছে। মুখটা ঈষৎ হাঁ করা। ওটার শরীর থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্তে শুভ্র বরফের কিছু অংশ কেমন লাল হয়ে উঠেছে। আজ খাওয়াটা খাসা হবে। মনে মনে ভাবে ভল্লুক। বরফের নীচে বয়ে চলা হিম বরফ জলের ধার থেকে আজ এটাকে টুপ করে শিকার করে নিয়েছে ও। আড়চোখে সীল মাছটাকে দেখে ও। চকচকে কালো চামড়ার নীচে পুরু চর্বি। শরীরে ওম মিলবে বেশ। পেটের মাঝে ক্ষিদেটা উশকে ওঠে। নখর থাবার আঁচড়ের গতি বাড়িয়ে দেয় ও। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত। আবহাওয়া ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। চারিদিকে ঘনিয়ে আসছে নিকষ অন্ধকার। এদিক ওদিক দেখে ভল্লুক রাজ। গুহা প্রায় তৈরী হয়ে এসেছে। এবারে ভূড়ি ভোজন শুরু করা যায়। যেমন ভাবা তেমন কাজ। তীক্ষ দাঁতে সীলটাকে কামড়ে ধরে এবারে আহারের প্রস্তুতি নেয় সে। ততক্ষণে আকাশ ছেয়ে গেছে মিশমিশে আঁধারে। চতুর্দিকে কেবল ভুতুরে কৃষ্ণ ছায়া দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আয়েশ করে শিকারে কামড় বসিয়ে নেয় ভল্লুক রাজ। খেতে খেতে হঠাৎ ওর মনটা খারাপ হয়ে যায়। মেরু অঞ্চলের শীতকালটা বড্ড বাজে। খাবার খুঁজে নিতে পরিশ্রম করতে হয় খুব। তাই এত ঠান্ডাতেও মেজাজটা কেমন চটে থাকে। অথচ গ্রীষ্মকালের সময়টাতে বেশ আয়েশ করে খাবার মিলে যায়। এত ঝুট ঝামেলা পোহাতে হয় না মোটেও। তখন সুস্বাদু মাছ, ছোট হাঙরের সাথে ফলমূলও মিলে যায় অনেক। কিন্তু এই হিম ঠান্ডাতে… আচমকা সামনের দিকে নজর পড়ে যায় ভল্লুক রাজের। ওগুলো কি? কোন কিছুর পায়ের ছাপ বলে মনে হচ্ছে। তীক্ষ দৃষ্টিকে আরও তীক্ষ করে নেয় ও। নাহ! ভুল নেই কোন! পায়ের ছাপই। তার মানে শিকার আশেপাশেই আছে। তবে ওটার অনুসন্ধানে বেড়িয়ে পড়াই ভাল। আগামীর ব্যবস্থা করে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ধীরে গুহা থেকে বেড়িয়ে আসে ভল্লুক রাজ। ওর থাবার নিচের কোমল লোম ওকে বরফ মাড়িয়ে চলতে সাহায্য করে। ভল্লুক রাজ ধীরে হেঁটে চলছে সামনে। এবার নাকটা বরফের সাথে ঠেকিয়ে লক্ষ্য বস্তুর ঘ্রাণ বুঝবার চেষ্টা করে ও। হ্যাঁ, যা ভেবেছে তাই। ঠিক পথেই এগুচ্ছে ও। প্রখর বুদ্ধি দিয়ে দিক নির্নয় করে নেয় ধূর্ত শিকারী। এরপর ছুটতে থাকে পরবর্তীর খোঁজে। নির্জন মেরুর বুকে তখন আঁধার নেমে এসেছে পুরোদমে।
(সমাপ্ত)
অংকনে- আমার বড় কন্যা, রিফা তাসফিয়া