কবি সুকান্তের একটি কবিতার পংক্তিতে বলা আছে
“কত চিঠি লেখে লোকে, কত সুখে, প্রেমে আবেগে স্মৃতিতে, কত দু:খ ও শোকে”
এছাড়াও কল্পলোকে মৌসুমী মেঘকে দূত করে প্রিয়ার কাছে নিজের বিরহ বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন কবি কালিদাস। মনে পড়ে যায়, ছেলেবেলার সেই আলসেমির চাদর মোড়ানো অলস দুপুর গুলোতে এবড়ো খেবড়ো রাস্তা মাড়িয়ে চলা সেই স্বর্গীয় বার্তা বাহককে। পরণে খাঁকি পোশাক। কাঁধে স্বর্ণলতার মত ঝুলানো ব্যাগ। আর তাতে ভরা সব আবেগী উড়োজাহাজ। ওতে কারও রৌদ্রজ্জ্বল আনন্দ, কারও বাদলে ছেয়ে যাওয়া বিষাদ, কারও বা ফাল্গুনী আশার নিটোল হাওয়ার দোলা তো কারও বা বিরহ বেদনা লুকিয়ে। দুয়ারে দুয়ারে সেই চৌকো সন্দেশাগুলো নিয়ে পৌঁছে যেত সেই স্বপ্ন দূত। অস্থির আঙ্গুলে দুয়ারের কড়া নাড়াবার শব্দের সঙ্গে ওর মুখের মিঠে বোল ফুলের রেণুর ন্যায় ছড়িয়ে পড়ত বাতাসে
– চিঠি এসেছে গো…চিঠি!
এই সুর যেন কোন অজানা ঝংকার তুলে নিত মনে। কারও স্নেহময়ী নেত্র যুগল হয়ে উঠত অশ্রু সিক্ত, কারও বা মনের শতদল হত বিকশিত। অজানা শিহরণে কেউ বা শিহরিত হত, হত উদ্বেলিত। সেই হলদেটে খামের প্রতি কেমন আশ্চর্য এক দুর্বার আকর্ষণ কাজ করত মনে। বলছিলাম, সময়ের পরিক্রমায় হারিয়ে যেতে বসা এক কালের সেই হৃদয় স্পর্শী বার্তা চিঠির কথা। বর্তমানের আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার কাছে যে কিনা তার আকর্ষণীয় সেই জৌলুস ভরা অধ্যায়ের ইতি টেনে নিয়েছে অসহায় ভাবে। এখনও মনে পড়ে, পূর্বে রাস্তার ধারে আগুন রঙা সেই ডাক বাক্সগুলোকে। গম্ভীর অতন্দ্র প্রহরীর মত যারা ঠাঁয় হয়ে রইত দিনভর। কখনও রোদের গনগনে তাপে, কখনও আষাঢ়ের আর্শীবাদে সিক্ত হয়ে, কখনও মৌণ জোছনায় স্নান করে, কখনও নিরালা দ্বিপ্রহরে নি:সঙ্গ কোকিলের ডাককে সঙ্গী করে নিয়ে যে তার বুকে ধরে নিয়ে থাকত কতশত কথারাজি। ব্যস্ত সকালে ত্রস্ত ডাকপিওনেরা হুড়মুড়িয়ে তাদের শূণ্য ঝুলি পূর্ণ করে নিত ওদের দিয়ে। আর আজ! এসব স্মৃতি চারণ এক প্রকার রূপকথারই নামান্তর। হ্যাঁ। অনুমান সঠিক। জানাতে চাচ্ছি, এই বিলুপ্ত প্রায় মিষ্টি যোগাযোগের মাধ্যম চিঠি নিয়ে কিছু কথা। কবে কোথায় আসলে চিঠির ব্যবহার শুরু হয়েছিল তা সঠিক ভাবে বলা মুশকিল। এ বিষয় নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মাঝে বিস্তর মত বিরোধ রয়েছে।
ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যায়, “পিস্টোগ্রাম” পদ্ধতিতে মানুষ প্রথম তাদের মনের ভাব প্রকাশ করত। সে হিসাব করলে এই “পিস্টোগ্রাম” পদ্ধতি কে চিঠির প্রাচীণ সংস্করণ বলা চলে। এই “পিস্টোগ্রামে” মানুষ যে সব ছবি অংকন করত তার মাঝেই মূলত কোন অন্তর্ভাব নিহিত থাকত। যেমন ধরা যাক, এই পদ্ধতিতে রাত বলতে বুঝানো হত এঁকে নেওয়া এক গুচ্ছ তারকাকে। আর এই বিচিত্র পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটে মেসোপটেমিয়ার সুমেরিয়ানঅঞ্চলে। পরে মিশরীয় “হায়রোগ্লিফিক্স” পদ্ধতি এই জায়গাটি দখল করে। এই পদ্ধতিতে বেশ কিছু প্রতীকের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করা হত। যেমন, ঠোঁটের ছবি দিয়ে মুখ এবং ‘জ’ শব্দটি বুঝানো হত। পরবর্তীতে সময়ের বিবর্তনে উদ্ভব হয় “হায়ারাটিক স্ক্রিপ্ট” নামক আরেকটি পদ্ধতির। তবে এতে করে নানা রকম বিভ্রান্তি তৈরী হত বলে জানা যায়। মজার ব্যাপার, ২২০০ খ্রীঃপূঃ ব্যবলনিয়াতে প্রেমিক “গিমিল” এক খন্ড প্রস্তরের ওপর তার কথিত প্রেমিকা “ কাসবুয়া” র নিকট হৃদয়ের যে আকুতি খোদাই করে পাঠিয়েছিলেন, ওটাই এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচাইতে প্রাচীন প্রেমপত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। আর ঠিক এভাবেই ৩৩০০ বছর পূর্বে মিশর রাজ সভা থেকে ইসরাইলের উদ্দেশ্যে পাঠানো পাথরে খোদাই করা বার্তাকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সবচেয়ে পুরোনো চিঠি বলে বিবেচনা করা হয়। প্রাচীন ভারত, রোম, সুমের এবং জ্ঞানের ভূ খন্ড চীনে প্রত্নতাত্ত্বিকরা পাথরে বা গুহার দেওয়ালে খোদাই করা প্রাচীন চিঠির হদিশ পেয়েছেন নানা সময়ে।
এবার আসা যাক, বার্তা প্রেরণের মাধ্যমের ব্যাপারে। জানা যায়, যিশুর জন্মের ২৪০০ বছর আগে ফারাও রাজারা দূত মারফত তথ্য চালাচালি করত। মতান্তরে পারস্য সম্রাজ্যে ডাক ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছিল বলে প্রমাণ মেলে। খ্রী:পূ: ৫৫০ এর ফরাসি রাজা কোরসের সময়কার নথি এ ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য সত্যতার দাবী করে। আবাস চীনের জিয়াং বা সাং বংশ দাবী জানায় চিঠি বা ডাক ব্যবস্থার আর্বিভাব তাদের হাত ধরেই হয়েছিল। ২২০ খ্রী: পূর্বে জ্যান রাজবংশীয় লি পুণরায় ডাক ব্যবস্থা চালু করে। তাং রাজবংশীয় ইতিহাসে ১৬৩৯ টি পোস্ট অফিস এবং ২০,০০০ বেশি ডাকপিওনের নমুনা পাওয়া যায়। আবার রোমেও ডাক বিভাগের ইতিহাস মেলে। খ্রী:পূ: ৬২ সালে রাজা অগাস্টাস কেসারার সময়ে ডাক সার্ভিসকে বলা হত “কারমাস পাবলিকাস”।
পূর্বে উপমহাদেশে বার্তা প্রদান করা হত নির্বাচিত দূতের মাধ্যমে যাদের “কাসিদ” বলে পরিচয় দেওয়া হত। তবে সেই সময় সবচাইতে জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল কবুতর। এক্ষেত্রে এসব আদুরে শ্বেত বিহঙ্গদের দেওয়া হত বিশেষ প্রশিক্ষণ। মলের মত বার্তা সকল এদের পা জড়িয়ে ধরে এদের ডানায় ভর করে পাড়ি দিত দূর থেকে দূরান্তে। ইতিহাসে বর্ণিত, খ্রী:পূ: ৫ম শতকে সিরিয়া এবং ইরানে কবুতরের মাধ্যমে বার্তা বহন চালু হয়। মজার ব্যাপার, রোমে অলিম্পিক গেমসের ফলাফল এই পারাবতের মাধ্যমেই জানানো হত। যার ঐতিহ্য ধরে রাখবার জন্য এখনও অলিম্পিক গেমসের শুরুতে পায়রা ওড়ানো হয়। চেঙ্গিস খাঁ তাঁর বিশাল সম্রাজ্যের খবর আদান প্রদাণ করতেন এই মেঘ সদৃশ নোটনের মাধ্যমে।
দিল্লীর প্রথম সুলতান কুতুবউদ্দীন আইবেক (১২০৬-১২১৯) এর মাঝে ডাক ব্যবস্থার বিস্তর উন্নয়ণ সাধন করেন। এক্ষেত্রে তিনি আরবদের অনুকরণে ঘোড়ার মাধ্যমে ডাক বিলি বন্টন ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। পরবর্তীতে সুলতান আলাউদ্দীন খিলজী, মুহম্মদ বিন তুঘলক তাদের শাসনামলে এর ব্যাপক উন্নতি ঘটে। বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার কলমে উঠে এসেছে তৎকালীন বিলি বন্টন ব্যবস্থার আরো অনেক মজার তথ্য। মূলত: সেই সময়ে পায়ে হেঁটে অথবা অশ্বের মাধ্যমে ডাক বহন করা হত। শের শাহের আমলে ঘোড়ার ডাকের প্রসার ঘটে। পরবর্তীর আধুনিক ডাক ব্যবস্থা হল সেই মধ্যযুগীয় ডাক ব্যবস্থার বিবর্তনের ফল। শেরশাহ ডাক ব্যবস্থার সুবিধার্থে নির্মাণ করেছিলেন সোনার গাঁও থেকে আফগানিস্তানের কাবুল পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তা (গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড)। তাঁর সময় ধরে জমিদারী শাসনামলেও ডাক ব্যবস্থায় এসেছে বিবর্তন। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের ৬৪ টি জেলাতে চিঠি আদান প্রদাণের সূত্রপাত ঘটেছিল। বাংলাদেশের প্রচলিত ডাক ব্যবস্থা আজ থেকে ৮০০ বছর আগের উপমহাদেশের প্রচলিত ডাক ব্যবস্থার আধুনিক রূপ বলে বিবেচিত হয়।
এই তো গেল পত্র নামার ক্ষুদ্র ইতিহাস কথা। এবারে আসি একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে। “চিঠি” কি সাহিত্য কর্ম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে? এই কৌতুহলের জবাবে বলা যায়, “চিঠি” শব্দটি কেবল মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম নয় বরং এটিকে সাহিত্যের একটি মূল্যবান অলংকার বলা চলে। চার ভাঁজের এই কাগজের মাঝে ঘুমিয়ে থাকা জাদুকরী শব্দে সাজানো সব বাক্য নিজেদের উন্মেলিত করে দিয়ে একটি সার্থক সাহিত্য কর্মের রূপ দেয় অতি সহজে। বলা চলে, মুক্তো মালাতে গেঁথে নেওয়া মুক্তোর ন্যায় পত্রে শোভিত শব্দরা সব বিন্যস্ত হয়ে জন্ম দেয় এক একটি গল্পের।
বলা বাহুল্য, পন্ডিত জহরলাল নেহেরু তাঁর কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকে যে চিঠিগুলো লিখেছিলেন সেগুলো সংকলিত হয়ে “বাবার চিঠি” শিরোনামে একটি বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। রবি ঠাকুরের “পোস্টমাস্টার” গল্পের পুরোটা চিঠির আদলে ফুটে উঠেছে, কবি গুরুর আরেক অনবদ্য সৃষ্টি “স্ত্রী পত্র” ও একই ভাবে চিঠির অলংকরণে সমৃদ্ধ হয়েছে। তারা শংকরের “ডাক হরকরা” তে নিষ্ঠাবান ডাক হরকরা ও তার দুশ্চরিত্র ছেলের গল্পে ফুটে উঠেছে ডাক ব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকা এক জীবনের কাহিনী। তেমনি সুকান্তের “রানার” কবিতার পংক্তির প্রতিটি আবেদনে খুঁজে পাওয়া যায় দুর্বার তেজস্বী রানারের জীবন সংগ্রামের আলেখ্য। এই সব সৃজন কিন্তু সমৃদ্ধ হয়েছে চিঠির অন্তর্নিহিত নির্যাসে।
চিঠি লিখা নিয়ে আরেকটি চমকপ্রদ ঘটনা রয়েছে পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শৈশব জীবনে। ঘটনাটা এমন যে, একবার জ্ঞান বীর অর্থ সংকটের মুখোমুখি হলে তিনি তাঁর বাবার কাছে অর্থ সাহায্য চেয়ে পত্র লিখেছিলেন। আর সেটি গোটাটাই লেখা হয়েছিল স্বরবর্ণে। যা ছিল ঠিক এরকম
“বব টক পঠও ত পঠও, ন পঠও ভত অভব মর”
যাতে আ-কার জুড়ে দিলে সেটি দাঁড়াবে এমন হয়ে
- বাবা, টাকা পাঠাও তো পাঠাও, না পাঠাও, ভাত অভাবে মরি।
সে যাই হোক না কেন, এ কথা দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলা চলে যে নিশ্চিত একটি মননশীল রূচিবোধ সম্পন্ন অর্থবোধক পত্র কিন্তু সাহিত্য কর্ম হিসেবে অতি সহজেই বিবেচ্য হয়। আগের দিনের হাতে লেখা সেই পত্র গুলিতে থাকত হৃদয়ের আকুতি প্রকাশ করতে নানা রকমের বৈচিত্র। কেউ বা প্রিয় জনের কাছে নিজের আবেগকে প্রকাশের নিমিত্তে ওতে মাখিয়ে নিত সুগন্ধের নির্যাস। কেউ বা সযত্নে ওটাকে আলাদা করে গুছিয়ে রাখত বইয়ের ভাঁজে। কেউ বা নিজের হৃদয়ের ভালবাসায় রাঙানো লাল গোলাপটিকে চিঠির সঙ্গে পুড়ে দিত খামে। যার স্নিগ্ধতা অনুরাগের আভা বিলিয়ে যেত নীরবে।
তবে আফসোস, সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগান্তকারী সব আবিষ্কার যজ্ঞের ফাঁদে পড়ে এই ঐতিহ্যবাহী চিঠি র কদর এখন বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে। সেই অনুভূতির স্পর্শে ফুটে ওঠা হস্তাক্ষরের জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে মুঠো ফোনের স্পর্শ কাতর পর্দা আর ল্যাপটপের স্ক্রীণে জ্বল জ্বল করে সেঁটে থাকা কতিপয় অ্যাপস আর মেইলের দৌরাত্ম। এখন আবেগ প্রকাশ করতে তাজা গোলাপ নয় বরং কতিপয় ইমুজি দিয়ে সহজেই মনের কথা অকপটে বলে ফেলা যায়। প্রিয়জনের প্রেম ভরা আবেদন পৌঁছে দেবার জন্য আর প্রয়োজন পড়ে না কোন রানারের। খামের মুখটা ঠিক মত আঠাতে সেঁটে নেওয়া হয়েছে তো? ডাক বাক্স থেকে আমার চিঠি খানা ঝুলিতে ভরা হয়েছে তো? এমন সব প্রশ্ন এখনকার প্রজন্মের কাছে হাস্য রসেরই সামিল। এখন মনের ভাব ঠিকানা মত পৌঁছে যাওয়া সেকেন্ডের খেলা মাত্র। আর সত্যি বলতে, এই দ্রুততাই বুঝি বিরহী বেদনার অজানা সৌন্দর্যকে অলক্ষ্যে ফেলে দিয়েছে। যার কারণে সম্পর্কের মাঝে সময়ের প্রয়োজনের যে মাধুর্য, কাছে আসার তরে যে অদৃশ্য এক আকর্ষণ লুকিয়ে থাকে সেটা সকলের অগোচরেই রয়ে যায়। আর সেই কারণে হয়ত বলা হয়ে থাকে, বিজ্ঞান জীবনকে দিয়েছে বেগ; কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ।
তথ্য সূত্র: পত্রপত্রিকা, জার্নাল, ইন্টারনেট