এরপর কত দিন যে গড়িয়েছে। অহ্নকুমার তার লাজুক মুখ লুকিয়ে নিয়েছে রাত্রী দেবীর ঘন কেশের আড়ালে। আকাশ জুড়ে জরিবুটির মত ফুটে উঠেছে একটি দুটি তারা৷ ক্রমে ওরা পরিণত হয়েছে নীলচে আলোর ঝাঁকে৷ আচমকা দেখলে মনে হয় এক থোকা জোনাকি বুঝি সেঁটে রয়েছে হেথায়। সে এক অনন্য আবেদন। নিশ্চুপ আমি, আনত আঁখিযুগল আমার উন্মেলিত করে নিয়েছি অসীমের পানে। বিভোর চোখে সাঁতরে গেছে অপার বিস্ময়ের লহমা। আমি দেখে গেছি নিশ্চুপ হয়ে। দেখে গেছি আনমনে। সাথে খেয়ালি মনের বাউন্ডলে তাড়নায় এঁকে নিতে চেয়েছি সেই মুখখানি। সপ্তর্ষি জেগে উঠে হঠাৎ সেথায়। আলোর রথ ছুটে যায় কোন সে অজানায়। চিত্রটা কেন যেন হব হব করেও সম্পূর্ণ হয়ে উঠে না কখনই। ক্ষোভ হয় বড্ড। আশ্বিন মাসে বয়ে যাওয়া অসময়ের ঝড়ের মতই হৃদয়ের ঈষান কোণে জাগে অভিমান৷ অনুযোগ। কিন্তু কার প্রতি? তোমার ওপর? না আমার? কী জানি? বড় গোলমেলে ঠেকে সংশয়খানি। শীতের শিশিরের মতই সন্দেহটা তির তিরতির করে এক সময়ে নেমে যায় মনের সবুজ সম্রাজ্যে। ম্লান হাসি। কেন জানি না? ঐ যে বললাম, উত্তর যে পাই না। মেলে না জবাব কোন, আর অন্য সব সময়ের মতই।
সময় বয়ে যায়, রেখে যায় সুক্ষ রেশ। বহতা কাকলি নদীর স্রোতটা কেমন ক্ষীণ হয়ে আসে এক সময়ে। ঠিক যেন যুবতীর গালে আঁখি চুঁইয়ে শুকিয়ে যাওয়া স্থুল অশ্রুধারার দাগ। স্রোতস্বীনির টলটলে যৌবনে নীরবে জাগে বার্ধক্যের পরশ। ওটার মজে যাওয়া পাঁকে লাফিয়ে চলা ব্যাঙের দল কী প্রহসন দেখিয়ে যায় নীরবে? হয়ত বা! জগতটা যে নিষ্ঠুর বড়। সুযোগ পেলে কেই বা নির্মমতার কড়া স্বাদ নিতে ছেড়ে দেয়, বল? এই রূঢ়তাকে অতিক্রম করবার সাধ্যি কার? আমিও তাই বিনা যুদ্ধেই হার মেনেছি। নিলজ্জের মত নামিয়ে নিয়েছি আবেগের সমর অস্ত্রখানি। অবশ্য সে তো নতুন কিছু নয় বৈকি। তুমি তো ঠোঁটকাটার মত বলেই ফেলতে “কাপুরুষ”। মিথ্যে বলব না। কথাটা লাগত ভীষণ তবে পরিণয়ের আগে যে সবই শ্রেয়। তাই হাসিমুখে অবলীলায় হজম করে নিতুম তোমার দেওয়া এই তেতো তকমা। তবে আজ মনে হয়, তুমি ভুল ছিলে না মোটেই। আসলেই আমি একটা। “কা… ধূর ছাই! ছেড়ে দাও। কী বকে যাচ্ছি এসব আবোল তাবোল৷ এসব কথা তো এখন…
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, এমন করেই দিবস গড়িয়ে যায়। এককালের বর্ষাস্নাত সতেজ সবুজ পাতায় লাগে শীতের রুক্ষতা। সবুজ যৌবনে কেমন হলদেটে বিবর্ণতা লাগে দেখেছ কী খেয়াল করে কখনও? অবশ্য অত সব দেখবার সময় কোথায় তোমার? আচ্ছা, তোমার কী মনে আছে সেই লেজ ঝোলা পাখিটার কথা। বাড়ির পেছনের দেওয়াল ভেঙে পড়া জায়গাটার ঠিক সামনেই যে প্রকান্ড অশ্বত্থ গাছটা, ওর দৈত্যের মতো হাত পা মেলে ঠাঁয় হয়ে থাকত। ভোরের বাতাস মৃদু লয়ে খেলে যেত ওর পত্রছায়ায়। ভর দুপুরের রোদ আর্শীবাদের মত চুঁইয়ে পড়ত ওটার ঘন সবুজে। দূর্বল শাখায় বসে দোল খেত ঐ পাখিটা। কী যেন নাম ছিল ওটার? ধূর! ছাই, মনে পড়ছে না! দেখ! ফের ঐ সমস্যা! হতচ্ছাড়া বয়সের এই এক দোষ, ইস্কুলের ব্লাকবোর্ডে লেখা চকের সাদা দাগের মতই পট করে মুছে যায় কেমন। বাস্তবিকই, বড্ড হ্যাঁপা, এই বুড়ো কালের। তবে দেখ না, কী আশ্চর্য! পাখিটার রঙটা কিন্তু মনে আছে আমার এখনও। চন্দনের মত হলুদ বরণ৷ লম্বা লেজ খানাতে আবার ঈষৎ লালের মিশেল। গলার কাছটা আষাঢ় মেঘের মত কুচকুচে কালো। কী সুন্দর সুর তুলত ওটা কন্ঠে! টুইই… টুইইই… আমার বেশ মনে আছে, তুমি তো ভীষণ মজা পেতে তাতে। কতবার কাছ থেকে ওই দজ্জালটাকে পরখে নেবার ছেলেমানুষি চেষ্টা করে গেছ। তোমার পদ্মকোমল পায়ের আলতো পদক্ষেপ কী সুন্দর ধীরে এগিয়ে নিয়ে যেতে ওটার দিকে। তোমার চরন তলে নিচে বিছিয়ে থাকা যে ঘাসের শ্যামল গালিচা, ওরা কেমন তোমার নূপূরের ঝুমঝুম ছন্দটাকে আলতো করে ওদের নরম বুকে জড়িয়ে নিত। কী অপূর্ব দৃশ্য! যেন কোন অদৃশ্য চিত্রশিল্পীর পটে আঁকা চিত্রকর্ম! বিস্ময় আর কৌতুহল যেন মেতে উঠত আমার কোন আদি সঙ্গম খেলায়। আমি হাসতুম কেবল। চুপিসারে দেখে যেতাম তোমার ঐ লুকোচুরি খেলা। তোমার পরণে তখন জড়িয়ে লাল পাড় ডুরে শাড়ি। ওর প্রশস্ত আঁচলে দিনশেষের রবিরাগ নিজেকে নির্দ্বিধায় নিলজ্জের মত সঁপে দিত। আগুন রাঙা আভায় কেমন অপার্থিব হয়ে উঠত চরাচর৷ আমি মুগ্ধ এক প্রেম পূজারী, নীরবে প্রেম বেদীতে লুটিয়ে পড়া রক্তিম জবায় সাজিয়ে নিতাম আমার প্রেমের অর্ঘ্য ডালি। আচমকা তুমি পিছু ফিরতে। তোমার কামনা ভরা মিষ্টি হাসি নীরবে চুম্বন করে যেত আমার সেই না বলা অনুভূতি। এই বল তো সত্যি করে, কিছু কী টের পেতে তুমি? বুঝতে পারতাম না অবশ্য, আনমনে কেবল লাজুক হাসি হেসে নিতুম। কী ভাবতে, বড় জানতে ইচ্ছে হত। তবে সত্যি বলছি, জানবার সাহস করা হয়ে ওঠেনি কখনও। পাছে সাঁঝ বেলায় মূর্ছে যাওয়া সন্ধ্যা মালতীর মতো যদি আমার পরিণয়ের কলি পুষ্পিত হবার আগেই ঝরে যায়! বড় ভয় হত। ভীষণ ভয়! জান তো? ভালবাসলে কী তবে এমনই হয়? এ কথাটাও অবশ্য আজ অবধি জানা হয়নি আমার৷ ভাবের পাথারে ডুব দেবার আগেই কল্পনার সুঁতোটায় টান পড়ত। বলছ কেন? হাসালে সত্যি। বলি, কেন আবার? আচমকা সেই হতচ্ছাড়া রঙিন বিহঙ্গ যে ডানা মেলে নিত অসীমে। ওর বর্ণিল পাখায় ভর করে কখনও ঢলে যেত অপরাহ্ন। ঠোঁটে বেজে যেত বিদায়ী কোন রাগ৷ তুমি কেমন অপলক হয়ে দেখে যেতে সেসব। চোখের গাঢ় কাজল পাঁপড়িতে বুঝি ভীরু হয়ে কেঁপে যেত না পাওয়ার আফসোস কিংবা বেদনা। অস্ফুট স্বর বেরুত তোমার কন্ঠ চিড়ে “ইশ…” ছোট্ট একটা শব্দ কিন্তু বাতাসের ঢেউ সাঁতরে কেমন শিহরণ জাগিয়ে তুলত আমার অন্তপ্রাণে। অবশ্য এসব ঘটে যেত তোমার অগোচরেই। পরাজিত প্রেমিকের মতই তাকিয়ে থাকতাম ঐ শূণ্যে। মখমল সদৃশ ছোট্ট পাখি যে তখন এক বিন্দু সদৃশ ঐ গগনের বুকে।
বিশ্বাস কর তুমি, আমার তখন খুব ইচ্ছে হত, ওটার আদুরে ডানা থেকে খুব যত্ন করে খসিয়ে নেই একটি রঙিন পালক। আর তার সুচারু ছোঁয়ায় মাটিতে ঝরে পড়া যে শাল পাতাখানা, তাতে তোমার অগোচরে খোদাই করে নেব একটা ছোট্ট কবিতা। অবশ্য কবিতা হত কী সেটা? কী জানি? তাতো জানি না। ছন্দ কৌশলে আমি আগাগোড়াই কাঁচা। তাই হয়তো বা হয়ে উঠত, কিছু এলোমেলো পংক্তি কিন্তু হতো তো আমার হৃদয়েরই গোপন অনুরণ গাঁথা। অবশ্য বরাবরের মত আমার এই অভিপ্রায়ও যে অপূর্ণ থেকে গিয়েছে। হবেই বা কী করে? কেন যেন কখনও নাগাল পাওয়া হয়নি সেই হলুদিয়া পাখির। হয়নি তুলে নেওয়া ওর ডানা খসা একটা রঙিন পালক। হয়নি লেখা আমার সেই গোপন কথাগুলো, যা আমি কেবল তোমাকেই শুনাতে চেয়েছিলাম। শুধুই তোমাকে।
হ্যাঁ। জান তো? এমন করেই কেটে গিয়েছে আরো কতগুলো দিন, কতগুলো মাস, পেড়িয়েছে কত কতটা বছর৷ ঘুরেছে কালের রথের চাকা। বদলে গেছে সব। তবে ঐ আকাশটায় এখনও তারা জাগে আগের মতই, খোলস বদলে আজও নব সাজে সেজে যায় তরু পল্লব। এখনও সূর্য ওঠে, অস্ত যায়, আমার নীরব কান্না সকল আষাঢ়ে নামে ঝুম বৃষ্টি হয়ে, দূর গহীনে নৃত্যে মেতে ওঠে ময়ূরের দল। আজো সর্ষে ক্ষেতে লাগে হলুদ ছোঁয়া, কান পাতলে শোনা যায় মৌমাছির পাগল করা গুঞ্জন। মায়াবতী শরতে নিয়ম করে নদী তীরে শ্বেত ঢেউ জাগে। আমি তাতে পাগলের মতো খুঁজে যাই তোমার সেই শুভ্র শাড়ির মায়া। আকুন্ঠ সেই প্রচেষ্টার ব্যর্থ রেশ মিলে যায় দেবীর বিদায়ী বাঁশির সুরে। এখনও মাঘের হিমেল পরশে খুব করে পেতে চাই তোমার আঙুলের স্বপ্নীল আবেশ। কিন্তু না। পাই না, কিছুতেই পাই না। অতপর এদিক ওদিক কেবলই ত্রস্ত হয়ে খুঁজে যাই সেই পাখিটাকে, যার সুরেলা গানে একদা আন্দোলিত হত তোমার চঞ্চল হিয়া। আর তাতে পূর্ণ হত আমার…
থাক৷ এসব আর কোন কথা নাই বা বলি আজ। কী-ই বা হবে, এত সব বলে? আজকাল অনেক কিছুই যে ভুলে যাই। তলিয়ে যাই বিস্মৃতির অতলে। সেই ভালো। পিছুটান বলে রাখতে চাই না আর কিছু। কিন্তু একি জ্বালাতন! নাহ! এও তো হয় না। ফিকে হয়ে আসা রঙধনুটা আবার যে জেগে উঠতে চায়। সেই রঙিন সুখকে উপেক্ষা করবার সাধ্যি যে নেই আমার৷ তাই সুযোগ পেলেই মরিয়া হয়ে ওটাকে খুঁজে যাই। তবে তার দেখা যে পাই না! পাবার কথাও নয়।
কী আজব! অনন্তলোকের কোন নিভৃতে যেন হারিয়ে গেছে ওটা। পেছনে ফেলে রেখে গেছে একরাশ শূণ্যতা। পরাজিত পথিক আমি, রিক্ত হাতে তুলে নেই সেই না পাওয়ার বেদনা। আর সেই আরাধ্য দিয়েই যে সাজানো আজ আমার ধূসর প্রেমের বেদী। যার ফ্যাকাশে জমিনে সম্রাজ্য বিছিয়ে নিয়েছে কিছু হাহাকার আর অপূর্ণতার জীর্ণলতা। আজো আমি নিশ্চুপ, নির্বাক, আনমনা। ভীরু মনে কেবল শুনে যাই বাতাসের ক্রুর গান আর কৃষ্ণ নিশির খোলা আকাশের বুকে মুখ তুলে নেওয়া হীরকরাজির মাঝে এখনও সঙ্গোপনে খুঁজে যাই সেই মুখটাকে৷ হুম৷ এখনও খুঁজি, সত্যি। কার মুখ আঁকি, শুনবে তুমি? বলব? নাহ! থাক। ছেড়ে দাও। কী হবে শুনে?