ডাহুক পাখির বিষাদ মাখা সুরে ভর করে প্রতিদিন দুপুরটা কেমন আলতো করে নেমে আসে। চৈত্রের দিনের এই দ্বিপ্রহরগুলো কেমন যেন অদ্ভুত নি:সঙ্গতার চাদরে মোড়ানো থাকে। দুধরাজ সর্পের মত গড়িয়ে চলে যাওয়া যে কাঁচা রাস্তা, ওটার দুপাশে জোৎস্না আলো করে ঘেটু ফুল ফুটে রয়েছে। দেখলে মনে হয়, যেন রাতের আকাশে জরিবুটির মত ফুটে ওঠা তারার মেলা ভুল করে পাতালে নেমে এসেছে। দূরে ছনের চাতাল দেওয়া বাসার দাওয়াইয়ে বসে ছনের মত চুল বিছিয়ে রোদে শুকিয়ে নিচ্ছে এক এলোকেশি বৃদ্ধা। শীর্ণ হাতের চামড়া ফুঁড়ে নীল শিরাগুলো কেমন ফুটে উঠেছে ওর। ঐ নাজুক বাহুতে শোভা পাচ্ছে এক জোড়া বাহু বন্ধনী। পরম মমতায় ওদের ওপর হাত বুলিয়ে দেয় বয়োজ্যেষ্ঠা। ওর পিচুটি পড়া দৃষ্টির মাঝে কি এক অজানা শিহরণের ঝিলিক খেলে যায় বুঝি। চুড়ির মৃদু অনুরণ কি তবে কোন ফিকে হয়ে পড়া অতীতের ওপর থেকে আচ্ছ্বাদন সরিয়ে নেয় তখন? কে জানে? বিছিয়ে থাকা উঠোনের ওপর নির্বিঘ্নে চড়ে বেড়াচ্ছে গোটা কতক হাঁস মুরগি। ওদের কন্ঠ নি:সৃত কঁকঁ শব্দটুকু কত অনায়সে দ্বিপ্রহরের নির্জনতাকে চৌচির করে দিচ্ছে। সোজা এগিয়ে ডানে মোড় নিলেই রাসুদের বাড়ির বড় পুকুর। ভেঙে পড়া ঘাটলার পাথরের ওপর থকথকে শ্যাওলা জমেছে। সেটাকে নির্বিঘ্ন ঠুঁকড়ে খাচ্ছে নাম না জানা এক পাখি। পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা হিজল গাছের ছায়া পড়েছে ঐ জমে থাকা স্বচ্ছ জলদে। আর কি অদ্ভুত ভাবে শতবর্ষী বৃক্ষের সবুজ ছোঁয়া লেগেছে ওখানে। যেন কোন শিল্পীর তুলির স্পর্শ কোমল শ্যামলতা ছড়িয়ে দিয়েছে ঐ শান্ত নীরদের পরে। বারদ প্রতিম এক জোড়া দুধেল শ্বেত হংস সাঁতরে বেড়াচ্ছে হেথায়। ওদের চলনে ঐ কোমল জলে ফুটিয়ে তুলছে সরল বক্ররেখার আঁকিবুঁকি। শিউলি ফুলের বোঁটার মত ওদের কমলা ওষ্ঠের ছোঁয়াতে ওখানে জেগে উঠছে ছোট ছোট তরঙ্গের ঢেউ! আমি বিমুগ্ধ হয়ে দেখে যাই কেবল। নির্জনতার মাঝেও আসলে কি এক অদ্ভুত মায়া জড়িয়ে থাকে সত্যি! আনমনে কত কথা কলির নুড়ি যে মনের ভেতরে সুপ্ত হয়ে থাকা ক্ষীয়মান স্রোতস্বীনীর বুকে তখন আলোড়ন জাগিয়ে তোলে! জানি না কেন যেন, কি এক অজানা হিসেব নিকেশ মিলিয়ে নেবার জন্য মনটা ছেলেমানুষের মতই ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কেমন এক অস্থিরতার ঝড় জাগে চিত্তে। আচমকা দুরন্ত অনীলের পিঠে সওয়ার হয়ে উড়ে আসা কতক শুকনো পত্ররাজি শরীরের ওপর ঝড়ে পড়ে। কখনও উবু হয়ে সেসব মুকুল কলি কুড়িয়ে নেই হাতে আবার কখনও বা উদাসী পায়ে তাদের সরিয়ে দেই পথ হতে। হাতের বামে চাতাল পেড়িয়ে জরা জীর্ণ গোয়াল ঘরটাতে এক গরুকে অলস ভঙ্গিতে বসে জাবর কাটতে দেখা যায়। ওর অবলা চোখ জোড়াতে শত কথার ঢেউ খেলে যাচ্ছ। একমাথা পাতা নিয়ে একটা শিশু গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে ঠাঁয়। ওর মৃত দু চারটি শাখা দুর্বল বৃদ্ধের কড়ি আঙ্গুলের মত পাশের বাতায়ন ছুঁয়ে দিয়েছে আলতো করে। কাছে ধারে কোথাও বুঝি কোকিল ডাকছে একটা। কি বিষন্নতা সেই সুরে! ঝির ঝির অনীল চপল বালিকার মত মল পায়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। থেকে থেকে শনশন ধূলি ঝড়ের দৌরাত্ম চোখে কেমন ঘোর লাগিয়ে তোলে। আর তাতে করে, ফেলে আসা দিনগুলোর ফিকে স্মৃতি গুলো কেমন হুরমুড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘোলাটে দৃষ্টির পরে।
– এই এই… আস্তে দৌড়া! আস্তে, নাইলে কইলাম…
চড়ুই পাখির মত অস্থির কলতান যেন বাতাস ছাপিয়ে কানে এসে বাজে। চমকে উঠে তাকাই। একদল দস্যি শিশু গাঁয়ের মেঠো পথ দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। নগ্ন শরীর ঘামে ভিজে চিকচিক করছে। নিম্নাঙ্গে বিবর্ণ শালপাতার মত লজ্জা নিবারণের আবরনটুকু ঢলঢল করছে বাতাসে। সেই দিকে যেন কোন ভ্রুক্ষেপই নেই ওদের। একহাতে কাপড় খামচে নিয়ে আরেক হাতে পাকড়ে নিয়েছে সরু কঞ্চি। আর তা দিয়ে নিপুন ভাবে চালিয়ে নিচ্ছে ওদের সামনে গড়িয়ে চলা বৃত্তাকার টায়ার। কি নিপুন ভাবে ওসবের গতি চালনা করে নিচ্ছে ক্ষুদে বাহিনী! কি আনন্দ ওদের চোখে মুখে! জাগতিক কোন কিছুই যেন ওদের স্পর্শ করে নিতে অক্ষম। ওদের কোমল প্রাণের আনন্দের সকল নির্যাসকে সঙ্গী করে নিয়ে বৃত্তের ঐ বলয় কেমন গড়গড় করে এগিয়ে যাচ্ছে সম্মুখে। কেন জানি না, ঐ দৃশ্যটা চাতক পাখির মত রোজ অবলোকন করে যাই। নিজের মাঝে লুকিয়ে পড়া সেই আমিটা চট করে যেন মাথা তুলে নেয়। উৎসুক নয়ন যেন খুঁজে বেড়ায় কোন চেনা ফ্যাকাশে স্মৃতির ক্যানভাসকে। বালক দল দৌড়ে যাচ্ছে। গাড়ির পরিত্যক্ত ঐ চাকাগুলি মেঠো পথের ওপর আনন্দ রেখ কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। তার চারপাশে হর্ষ ছাপ ফেলছে কতগুলো কচি পায়ের ছাপ। আমি কেমন লোলুপ দৃষ্টিতে সেই দিকে তাকিয়ে থাকি। আপন মনে ওসবের মাঝে খুঁজে নিতে চাই নিজের হারিয়ে যাওয়া চিহ্নটাকে। প্রজাপতির দল এগিয়ে গিয়েছে অনেকখানি। ওদের কলতান ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে উঠছে সমীরণের পালকিতে। আবারও নীরবতা গ্রাস করতে শুরু করেছে চারপাশের গুঞ্জনকে। কেমন যেন ভয় হয় হঠাৎ! তবে কি আজও ওরা আবার হারিয়ে যাবে? আর নাম না জানা অচেনা পাটে আমি আবারও পড়ে রব একা? মরিয়া হয়ে উঠি হঠাৎই। কি এক পাগলপাড়া জিদ যেন চেপে বসে মাথায়। বিহ্ববল চোখে দেখে যাই চারিদিক। না, না আজ আর কিছুতেই ওদের হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। যে করেই হোক খুশির ঐ লহমাকে আজ ছুঁয়ে নিতেই হবে। ঐ ঘূর্ণি চাকার মাঝের ঘূর্ণায়মান আনন্দে যে আমারও আনন্দটুকুও মিশে রয়েছে। ওটাকে কিছুতেই বিলীন হতে দেব না আমি। কিছুতেই না। ঐ তো! দৃষ্টির সীমানায় তখনও ওরা দাঁড়িয়ে। সচকিত হয়ে উঠি। আর আজ অনেক দিন পর আমার মাঝের সেই ঘুমিয়ে থাকা আমিটা সেই পুরাতন চিরচেনা হাঁক ছাড়ে এবারে
- এই, এই, দাঁড়া…দাঁড়া বলছি…