ইডেনের মোড় পেরিয়ে নীলক্ষেত মোড়ের কাছাকাছি হতেই বিশাল জ্যাম। ধুন্দুমার বেগে ছুটে চলা সমস্ত চার চাকার যান যেন আলসে গৃহপালিত জীবের মতই মুখ থুবড়ে জাবর কাটতে শুরু করল। ইদানিং জ্বালানি তেলের যে দাম বেড়েছ! পারতপক্ষে গাড়ির ছোট্ট শীতল বাক্স বেশিরভাগ সময়ে বিশ্রামের ওপরেই থাকে। আজ দুপুরের পর ইকোনোমিকস এর একটা ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস ছিল। ইচ্ছে ছিল সুযোগ পেলে বাতিল করে দেবার কিন্তু সামনে মিড। তাই গোবেচারা নিরীহ ছাত্রীদের ওপর এই রিক্স নিতে মন চাইল না। তাছাড়া দায়িত্ববোধ বলেও তো একটা ব্যাপার আছে একজন শিক্ষকের জন্য। তাই না? মন চাইলেই কী…
– ম্যাডাম এসি কি চালু করব? জ্যাম কখন ছুটবে বোঝা যাচ্ছে না!
ড্রাইভারের কথায় বর্তমানে ফিরে আসি। গাড়ির স্টিয়ারিং এ টকটক আওয়াজ তুলে বলে, আসলাম। ছেলেটার নাম আসলাম হাসান৷ বেশ চটপটে। বুদ্ধিমান। দায়িত্ববোধ বিষয়টা ওর মাঝে ভীষণ ভাবে উপস্থিত। অভাবের সংসারে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়ার পরে পরিবারের হাল টেনে নিতে লেখাপড়ার অদম্য স্পৃহাটা অঞ্জলির মতই বিসর্জিত হয়েছে জলে। ওই নিম্নবিত্ত পরিবারে যে গল্প থাকে আরকি! আসলাম চাকরিতে যখন জয়েন করে তখন উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছে মাত্র। সেদিনই হ্যাংলা পাতলা যে ছেলেটা মাটি থেকে চোখ তুলে কথা বলতে পারত না সে কিনা আজ কতটা আত্মবিশ্বাসী! সময় আর পরিস্থিতি মানুষকে কতটা বদলে দেয় আসলে! হ্যাঁ ওর পড়া চালিয়ে নেবার দায়ভার নিজেদের কাঁধে ওঠাতে চেয়েছিলাম৷ কিন্তু ও কখনো রাজি হয়নি৷
– কেন রে? আমরা কী কেবলই মালিকই তোর জন্য…
– তা নয় ম্যাডাম। আসলে এখন লাগবে না কিছু। ডিউটির পর একটা পার্ট টাইম করি। ও দিয়ে চলে যায়। যদি কখনও প্রয়োজন হয় তখন না হয়…
“তাহলে তুই…” আর কথা বাড়াইনি৷ ওর খামোশি দেখে নিজের জবানেও যতিচিহ্ন বসিয়ে নিয়েছিলাম৷ সেই থেকে শুরু করে আজ অবধি। তা কত? প্রায় তিন বছর তো হবেই! এই লম্বা সময়কাল…
“ম্যাডাম, এসি দেব?” এবার খেয়াল হল ঘামে পিঠের কাছে কামিজ জবজব করছে। কানের নিচ বরাবর ঘামের চিকন স্রোতও টের পাচ্ছি বেশ৷ গরম কমাতে মাথার কাপড়টা একটু হালকা করে নিতে নিতে বলি দাও। আমার কথায় চুপচাপ কাজ করে নেয় আসলাম। এদিকে রাস্তার অবস্থা রীতিমতো বেহাল। অসংখ্য গাড়ির হর্ণ, রিক্সার টুংটাং, ধ্যাড়ধ্যাড়ে দানবাকৃতির জীর্ণ বাস এদের সরগোলে মনে হচ্ছে পাইক পাড়ার মোড়ের বস্তির খিস্তি জেগেছে। এদিকে বিকেল গড়িয়ে আকাশে তখন সান্ধ্য পরিক্রমার প্রস্তুতি মত্ত প্রকৃতি রাণী৷ নেহাতই চাঁছাছোলা রূক্ষ নগর হলে কী! প্রকৃতি তো তার আপন মাধুর্য স্বভাবমতই মেলে ধরতে চাইবে এতে তো কোন সন্দেহ নেই। মুহূর্তের জন্য বিরক্তি ভুলে আমি তন্ময় হয়ে আকাশ দেখতে থাকি। অদৃশ্য কোন চিত্রকর ততক্ষণে তার তুলির নরম আগায় পশ্চিমের ক্যানভাসে একটু একটু করে বেগনে আভা ফুটিয়ে তুলছেন। রাস্তার ওপারেই নীলক্ষেত। গাদাগাদা বইপত্রে ঠাঁসা এক আলাদা সম্রাজ্য৷ ওটা যেন এক ভিন্ন জগত। টিমটিমে হলুদ বাতির আলো যখন থরেথরে সাজানো বইয়ের ওপর ঠিকরে পড়ে তখন কেমন নেশার সুরমা লেগে ওঠে চোখে৷ ছাত্রবয়সে কত যে চষে বেরিয়েছি এখানে! উপন্যাস, গল্প, কবিতা প্রবন্ধ কী বা বাদ থাকত তালিকায়! ফাইনাল শেষে এক গাট্টি বই কিনে পিছমোড়া করে বাড়ি ফেরা৷ উফ! সেকী অনুভূতি! বইয়ের নতুন পাতার ঘ্রাণ আর ফড়ফড়ে শব্দ ষষ্ঠ ইন্দ্রে কী এক মাদকতা জাগিয়ে তুলত। এখনও অবশ্য যাওয়া পড়ে এখানে। পেশা শিক্ষকতা হওয়ায় নাড়ীর টানটা বুঝি আজও অবিচ্ছেদ্য৷ তীর্থের কাকের মত তাকিয়ে দেখি। নিজের কলেজ পড়ুয়া ছেলেটার কথা মনে হয়। রাশিক। মেধাবী, চটপটে। সারাদিন একাডেমিক বইপত্রে ডুবে থাকে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার খুব শখ। সব বিষয়ে এত আগ্রহ কেবল বাংলায় অনীহা। সেদিন প্রশ্ন করলাম প্রিয় কোনটা, কবিতা না গল্প? এমন ভাবে তাকাল কথাটা শুনে যেন কোন আজব কথা শুনছে।
– এসব পড়ার সময় আছে? আর এগুলো পড়ে লাভ কী? মাছি তাড়ানোর মত তাচ্ছিল্য করে বলে ছেলে আমার।
বিষম খেলাম প্রচন্ড। তবে হাল ছাড়ি না। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলি,
– সব কি লাভের কথা চিন্তা করেই কর? আর তোমার কী মনে হয় আসলেই কোন ফায়দা নেই?
– সামনে ইয়ার ফাইনাল, মা। এই সমস্ত…
কথাটা শেষ করবার বুঝি প্রয়োজন অনুভব করল না, কাঁধ নাচিয়ে হাতে ধরে থাকা জ্যাম পাউরুটিতে কামড় বসায় রাশিক। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ জোড়া টেবিলে রাখা মুঠোফোনের ওপর। না সেখানে কোন টিউটোরিয়াল নয় ইংরেজি অ্যাকশান মুভি চলছে। ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলি। অনভিপ্রেত অপছন্দের এই দৃশ্য আজকালের জন্য যে চিরন্তন সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। হলফ করে বলতে পারি, এই যে ছেলেটি একে এখন বলিউড তারকাদের নাম বলতে বললে গড়গড় করে সব তার পুরো তালিকা উগরে দেবে কিন্তু যদি আমাদের সাহিত্য জগতের কারও নাম জানতে চাই তাহলে…
“খালা, ফুলের মালা লইবেন? চাইরটা ভাত খামু।” জানালায় এক নোংরা শ্রীহীন মুখ উঁকি দেয়। চূড়া করে বেঁধে রাখা চুলগুলো ধূলোবালি মেখে পিঙ্গল বর্ণ ধারন করেছে। শ্যামলা গায়ের রং কিন্তু চেহারাটা কাটাকাটা। এক হাতে সরু বাঁশের লাঠিতে ঝুলছে কতগুলো ফুলের মালা। চোখে হাজারো অনুনয় নিয়ে মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যাগ থেকে দশটা টাকা বের করে ওর দিকে দিতেই মেয়েটা আবার বলে, “পাঁচটা মালা চল্লিশ ট্যাকা একলগে।” অগত্যা পঞ্চাশের নোটটাই গুঁজে দেই এবার ওর হাতে। একমুঠো সুবাস আমার হাতে সঁপে দিয়ে মেয়েটা অদৃশ্য হয়ে যায় ভীড়ে। পাশেই স্ট্রিট বেকারে ঠাঁয় হয়ে থাকা গাছগুলোর পাতার মাঝে হালকা বাতাস পা দুলিয়ে বসে রয়েছে। ওদের পাতার সবুজ রঙের জায়গায় ঐ মেয়েটার চুলের মতই ধূসর বর্ণ জেগেছে। পরিস্থিতি বুঝি সকলকেই তার প্রকৃতি থেকে এমন করেই বদলে ফেলে। বইবাজারের ফুটপাত জুড়েও বই এর পসরা। বিরিয়ানি ফুচকার ঘ্রাণে থইথই বাতাস৷ সাঁঝের মৃদুমন্দ বাতাসে ওপরে তারের সাথে ঝুলানো ব্যানারগুলো রংবেরঙের পতাকার মত দুলছে। আলমাস সিনেমা হলের চূড়া জুড়ে সেঁটে রয়েছে প্রকান্ড এক পোস্টার৷ সিগারেট ঠোঁটে চেপে উদ্ধত যুবকরা তাদের প্রেমিকাদের নিয়ে অপেক্ষা করছে প্রেক্ষা গৃহের আলোছায়ায় রঙিন পর্দার স্বাদ উপভোগ করতে। এক আমড়াওয়ালা ওর টিনে সাজানো ডিম্বাকৃতির আমড়াগুলোর ওপর পানি ছিটাতে ব্যস্ত৷ দুফিতার স্যান্ডেল, মাথার স্কার্ফ, চুড়ি, ক্লিপ এসবের সমাহারে মৌচাকে সঞ্চিত মধুর প্রলোভন জোগাতে হকাররা মুখে তুলছে বিচিত্র বোল। বামে নিউমার্কেটের দেওয়ালে আঁকা মোটিফগুলো আঁধার ফুঁড়ে ঢাকার ঐতিহ্য বয়ান করে দিতে যেন দাঁতে দাঁত পিষে যাচ্ছে। ভেতরে দাঁড়ানো মসজিদের চূড়ার সন্ধ্যার হালকা তমসা জমাট বেঁধে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে। দুধারে বয়ে চলেছে সমুদ্রের ঢেউ এর উত্তাল জনতার ঢল। কারও যেন ফুরসত নেই৷ এতটুকু সময় নেই। একটুও বুঝি কারও স্বস্তি নেই। নিজেকে খানিক সময় দিতেও এখন মানুষ বুঝি বড্ড কৃপণতা দেখায়। জীবন আসলে…
“যে অবস্থা, পৌঁছতে যে কতক্ষণ লাগে…” আসলামের গলা। এবার ওর দিকে দেখি। স্টিয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে কখন যে স্টার্ট থামিয়ে দিয়েছে ও। ভাবনার আতিশায্যে টেরই পাইনি। জানালার কাঁচ নামিয়ে দেওয়াতে হালকা অনীল স্পর্শ চোখেমুখে খেলে যাচ্ছিল৷ ভালোই লাগছে। আচমকা এই বাজে সরগোলকে বড্ড আপন মনে হচ্ছে৷ আসলামের হাতে দেখলাম একটা বই। ঘাড়ের পেছনে কলার ঠেলে দিয়ে বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে রয়েছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ে যাচ্ছে ও। ওকে দেখে মনে হল পৃথিবী থেকে ও যেন বিচ্ছিন্ন কোন সত্ত্বা। কী পড়ছে ও এত মন দিয়ে? সামনে এক্সাম নাকি কোন? কই বলেনি তো কিছু এই ব্যাপারে… এতটা দূরত্ব বাড়িয়ে দেবার কারণে একটু রাগই হলো বৈকি!
“কী পড়ছিস, এত মন দিয়ে?” গলা তুলি এবার। আসলাম কিছুটা চমকে গেল। কিছুটা বিব্রতও হল বুঝি। থতমত খেয়ে হাতের বইটা পাশের সীটে নামিয়ে নেয়। সামান্য ঝুঁকে দেখলাম একটা উপন্যাস৷ বেশ স্বাস্থ্যবান। মলাটটা বিবর্ণ। মনেহয় পুরোন বই৷ নামটা হলো দূরে কোথাও। লেখকের নাম সায়ন চৌধুরী। নামটা অচেনা। কোন লেখক ইনি? নতুন লিখছেন কী? আজকাল লেখকদের পরিচয় তো তেমন জানি না৷ বই এর কথা লেখকের প্রচার আর আমাদের সমাজে হয় কই? এসব তো সময় অপচয়েরই সামিল৷ তবে আসলামের এই আচরণে চমৎকৃত হই৷ ছেলেটা তাহলে বই পড়তে ভালোবাসে! বাহ! এটা তো জানা ছিল না! আজকালকার ছেলেমেয়েরা তো বই বলতেই নাক সিঁটকোয়। তাও বা খেয়ালের বশে চটি বই এর মত কিছুতে যা সাময়িক মজে থাকে বাকি তো সবই বোগাস। এই যে, আজ ক্লাসেই তো এক স্টুডেন্টকে জিজ্ঞেস করলাম
– বাড়িতে কী কর অবসরে?
– নেটফ্লিক্স দেখি ম্যাডাম।
– নোটফ্লিক্স? তা বেশ তো আর…
-গ্রুপে ফ্রেন্ডরা আড্ডা দেই৷ টিকটক… ম্যাডাম জানেন? আমার টিকটক ফলোয়ারস হলো…
– বই পড়? কেন জানি না চট করে এই প্রশ্ন করি চঞ্চলামতিকে। আমার কৌতুহলের চাইতেও জবাব মেলে দ্বিগুন গতিতে। “সময় পাই না ম্যাম।” সময় নেই। জড়তা ছাড়া কী চমৎকার উত্তর৷ আসলেই তো, এতবসব সামাজিক মাধ্যমের জাল ভেদ করে বই পড়ার সময় কই এখন আর? নিজের ছেলেটার পাশাপাশি মেয়েটার আবছা ছবিটা হঠাৎ এখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমার৷ বিরক্তি মাথায় চড়ে বসার আগেই প্রসঙ্গ পাশ কাটাতে আসলামকে বলি, “পড়ার অভ্যেস আছে, তবে?”
– ওই আরকি ম্যাডাম! একটু আকটু… বই পড়লে সময়টা কাটে ভালো আর…
– সোশাল নেটওয়ার্কিং এ থাকিস না?
“তেমন না। ভালো লাগে না। স্কুল কলেজে লেখার হাত ছিল৷ কবিতা লিখতাম।”এবার নড়েচড়ে বসি। বলে কী ছেলে! ও কবিতা লিখে? মুখ ফসকে বিস্ময়টা বেরিয়েই যায় আমার, “তাই নাকি? এখনও লিখিস? আছে তোর সাথে এখন?” মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলো অযথাই এলোমেলো করে নিয়ে আসলাম বলে, “জি, ম্যাডাম।”
“কই দেখি?” আমি উত্তেজনা চাপিয়ে রাখতে পারছিলাম না। পানির ধারার মতই সেটা তার গতি তৈরী করে নিচ্ছিল। আসলাম চুপ করে বসে আছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে বেশ অপ্রস্তুত৷ এবার ওকে সহজ করবার জন্য হেসে ফেলি। বলি,
– এত লজ্জার কী আছে? আরে, তোর কলম কথা বলে এটা কী লুকোনোর বিষয়? এটা সগর্বে চিৎকার করে বলার বিষয়৷ লেখকের কলমকে কখনও লুকিয়ে রাখতে নেই তার সৃজন প্রকাশ্যে আসা জরুরী রে বোকা। তা না হলে এই জাতি সোনালি সাহিত্য সময় গড়বে কী করে? হ্যাঁ? মুখ নামিয়ে নয় মাথা উঁচিয়ে সকলকে বলবি তুই কবি৷ তোর কলমে জীবন হাসে। কাঁদে। স্বপ্ন দেখে। যে কলমে জীবনের কথা লিখিস সেই কলমে নিজের পরিচয়টা লিখতে হবে সাহসের সাথে, সম্মানের সাথে৷ এতো লজ্জা নয় গর্ব। দে দেখি, তোর কবিতা গুলো।
আমার কথায় একটি কম্পিত হাত সামনে এগিয়ে আসে। সেই হাতের আঙুলে শক্ত করে ধরে নেওয়া একটা সস্তা দামী ডায়েরী। আমি ওটা হাতে নিতেই মলাটের ওপর শীতের সকালের শিশিরের মত বসে যাওয়া পরম তৃপ্তির ঘামের অস্তিত্ব টের পেলাম। অদ্ভুত ভালো লাগায় মনটা ভরে উঠল। কেমন এক অজানা পুলক জাগছে চিত্তে। অনুভব করছি এক শিহরণ৷ সেই অনন্য অনুরনে সিক্ত হয়ে ডায়েরিটা চোখের সামনে মেলতে যাব তো তখুনি রাস্তায় এক আলোর ঝলকানি খেলে গেল। মনেহল তারাবাতি জ্বলে উঠল বুঝি৷ কী বিষয় বুঝার আগেই আসলাম চেঁচিয়ে উঠে। “ম্যাডাম, ঐ যে দেখেন…।” ওর প্রতিক্রিয়ার কারণ খুঁজবার জন্য আমি জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেলতে দেখি, নিউমার্কেটের এই ব্যস্ত মোড়ে ইলেকট্রিক বিলবোর্ডে ধীরে ফুটে উঠছে এক তরুণের অবয়ব। এ আবার কে? কোন সিনেমার হিরো না রাজনৈতিক নেতা? আমার মৃদু স্বরে বকে যাওয়া প্রশ্নের এক অভিনব জবাব পেলাম ।
– ইনি, কিংকর ভাই। এই সময়ের জনপ্রিয় লেখক ম্যাডাম। বইয়ের কথা লেখকের কথা সবাইকে জানাতে ইনি…
এরপর আসলাম কী বলল তা আমার কানে অতটা প্রবেশ করল না ঠিক তবে এর গুঢ়তা পৌঁছে গেল হৃদয় অবধি। লেখকের ছবি বিলবোর্ডে! এমন দৃশ্য আমাদের দেশেও হয়? এও সম্ভব? এমন দৃশ্য এর আগে কী কোথাও দেখা হয়েছে আমাদের? আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি শ্রেণীকক্ষের দেওয়ালে সেঁটে থাকা চৌকা ব্ল্যাকবোর্ডের মত জিনিষটার দিকে। একে একে জ্বলে উঠছে আলোকরাজি। খোদিত হয়ে উঠছে এক কলমযোদ্ধার মুখ। আরে! এমন প্রজন্মই তো দরকার এখন আমাদের৷ বইবিমুখ এই নড়বড়ে সমাজকে বই এর মলাটের জাদুতে মাতিয়ে নিতে এমন কলম জাদুকরদের যে এখন বড্ড প্রয়োজন। যারা কিনা এই… জ্যাম ছেড়েছে। শরীর ঝাঁকিয়ে চলতে শুরু করেছে গাড়ি। পেছনে সরে যাচ্ছে চিরচেনা সব কিছুর সাথে এক অভিনব আনন্দ আবিষ্কার। আচমকা এক কৌতুহল অনুভব করি। আচ্ছা, এই দৃশ্য কী বদলে দিতে পারবে রাশিকের ভাবনাটাকে, পারবে কী বদলে দিতে ক্লাসের ওই ইকোনোমিকস পড়ুয়া ছাত্রীটার চিন্তাটাকে? এই দৃশ্য কী সক্ষম হবে বই পড়ার জন্য ওদের সেই একটুখানি সময় বের করে নিতে? নিজেদের হাতে পরম যত্নে আগলে রাখা মোবাইলটার বদলে পারবে কি ওখানে একখানা বই গুঁজে দিতে? পারবে। মন বলছে, অবশ্যই পারবে। ইনশাআল্লাহ। মনের মাঝে “আশা” নামক সুপ্ত চারাগাছটা আবার সূর্যালোক ছুঁয়ে নেবার আশায় মুখ উঁচিয়ে নিয়েছে আমার। বই এর পাতায় সাজানো গল্পগুলোর সালোকসংশ্লেষণ এবার হবেই হবে। তা নাহলে এই অসাধারণ দৃশ্যের জন্ম যে আজ কোনভাবেই হত না। গাড়ির গতি বেড়েছে। পেছনে ছুটে চলেছে চেনা সবকিছুর সাথে এক নব আনন্দ প্রাপ্তি। জানালা গলে ভেতরে দস্যি পবন ঢুকে পড়ছে হুহু করে। থুতনিতে ঝুলতে থাকা মাস্ক নাকে উঠালাম না। ইচ্ছে করল না বদলে সীসা ভরা দূষিত এই বাতাসও আজ ফুসফুস ভরে টেনে নিলাম প্রাণ ভরে। আমি আবারও মাথা ঘুরিয়ে দেখি৷ বিলবোর্ড ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। যেন হাজার হাজার জোনাকি ওতে সওয়ার হয়ে ফুটিয়ে তুলতে চাইছে অদম্য এক স্পৃহা। গভীর ভাবে বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করি স্পষ্ট হতে থাকা সেই তরুণের মুখ। যার দৃপ্ত কাঠামোর সাথে ফুটে উঠছে আমার মত আরো অনেক বই অনুরাগীর মনের গভীরে বেজে যাওয়া সেই সুপ্ত ইচ্ছেখানা
“শুদ্ধতায় আর হৃদ্যতায় পৃথিবী বইয়ের হোক।”
(সমাপ্ত)
#সোনিয়াতাসনিম
#soniatasnimkhan