শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ক্যাফেটেরিয়াতে নীরবতার ঢেউ সাঁতরে বেড়াচ্ছে। গরম কফির ধোঁয়ার সাথে সফট টোনের কান্ট্রি মিউজিক সারাদিনের ক্লান্তিটা পরম যত্নে ধুয়ে দিচ্ছে। কিছু চাপা গুঞ্জন আর কাঁটা চামচের টুংটাং ছন্দটাই মাঝে মধ্যে মৌণতার ছন্দে একটু ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে, এই যা। চারদিকের এই গাম্ভীর্যের বলয়কে একপাশে সরিয়ে রেখে চুপচাপ নিজের কাজ করে যাচ্ছে স্নেহা। গোলাপ পাপড়ির মত কোমল ঠোঁট দুটো একটু পরপর কফির কাপ চুম্বন করে নিলেও সুবিশাল সাগরের মত দৃষ্টি ল্যাপটপের স্ক্রিনে নিবদ্ধ। দু হাতের স্বপ্নীল আঙুলগুলো কী বোর্ডের ওপর ব্যস্ত পরশ বুলাতে ব্যস্ত। স্নেহা কিছু সময় পরপর গভীর ভাবে কিছু ভাবছে, কখনও চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে আঙুল মটকে নিচ্ছে। ওর ঘন কালো চুলের কিছু অংশ সামনে ঝুকে গিয়ে ওর কপাল ছুঁয়ে দিচ্ছে খুব যত্ন করে। চিন্তার তরঙ্গ খেলে বেড়াচ্ছে ওর ভ্রুকূটি জোড়াতেও। স্পর্শকাতর পর্দার সাদাটে আলোর আভা ওর মুখের ওপর পড়াতে বুঝি একটু অস্বস্তি হচ্ছে স্নেহার। অপ্রস্তুত ভাব কাটাতে তাই মাঝেমাঝে ডান হাতে ওর চশমার ডাটটা অযথাই একটু খানিক সময় পর পর চেপে নিচ্ছে। ছোট গোল টেবিলটার অপর প্রান্তে বসে রয়েছে অভীক। একমনে স্নেহাকে দেখে যাচ্ছে ও। তবে একথা ঠিক এই খানিক সময় আগেই ও নিজেও স্নেহার মতই ব্যস্ত সময় পার করেছে। যদিও ব্যস্ততার আবেশ কাটেনি এখনও। তবে ক্লান্তিটা সিন্দাবাদের নাছোড়বান্দা বুড়োর মত কাঁধে চেপে বসেছে বড়। অগত্যা নিজেকে খানিক রিল্যাক্স দিতে আপাততঃ কাজের বোঝাকে তুলে রাখাটাই শ্রেয় বলে মনে করেছে অভীক। মাল্টিন্যাশনাল এই কোম্পানিতে স্নেহা আর ওর জয়েনিং প্রায় একসময়েই হয়েছে বলা চলে। প্রেস্টিজিয়াস পোস্ট সাথে হ্যান্ডসম স্যালারি, শুরু থেকেই দুজনে বেশ উদ্যোমী হয়ে কাজ করে আসছে। ফালাফল বছর তিনেকের মাঝেই তরতরিয়ে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে চলা। হুট করে বিয়েটা সেরে ফেলাতে নিজেদের গুছিয়ে নেবার ব্যাপারে একটা যে সংশয় ছিল মনে, সেটা যেন অনেকটাই কেটে উঠেছে এই প্রাপ্তির সুবাদে। আজ এই টার্গেট রিচ করা, তো কাল ঐ প্রেজেন্টেশন হরহামেশাই একটা না একটা চ্যালেঞ্জ তো লেগেই রয়েছে। ওরাও উপভোগ করে বেশ। “ডায়ানামিক কাপল” বলে ইতিমধ্যেই সহকর্মীদের মাঝে পরিচিতি গড়ে তুলেছে অভীক আর স্নেহা। সকলের চোখে ওদের প্রতি স্তুতির বানের সাথে ঈর্ষার ঝলকের উপস্থিতিটাও দারুণ উপভোগ্য লাগে নিজেদের কাছে। সবসময় মনে একটা তাড়না ছুটে বেড়ায় যে, আরও, আরও একটুখানি সাফল্য, ব্যাস! তবে মুশকিল হলো, এই আরও একটু লোভের হাতছানির সমাপ্তি ঘটেনা মোটেও। এর লেজের পরিধি বুঝি প্রতিনিয়ত একটু একটু করে বেড়েই চলেছে। আর এই চাওয়া পাওয়ার খেলায় নিজেদের মাঝ থেকে নিজেরাই যেন কর্পূরের মত উবে যাচ্ছে ওরা দুজনে কোথাও। হঠাৎ করে এই আক্ষেপটা নিজেদের ভাবিয়ে তুললেও, পরে নিছক বোকা আবেগি খেয়াল বলে একে দারুণ ভাবে পাশ কাটিয়ে যায় দুজনেই। সাফল্যের চাঁদ ছুঁতে গেলে এসব নিয়ে ভাববার অবকাশ আর কোথায়? তাই আজকাল ব্যস্ত এই মোহের জাল কেটে নিজেদের জন্য আলাদা করে কোন মুহূর্ত আর আবেগী সুঁতোর ফোঁড়ে বুনা হয়ে ওঠে না। দিনশেষে দু একটা বাঁধাধরা কথা আর এরপর একই বিছানায় দুজনার দুপাশ ফিরে রাত্রি পার করে দেওয়া। ব্যাস! জীবন যেন এতটুকুতেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে ভালোই। কেন যেন আচমকা এমন খেয়ালের পাথারে সাঁতরে যাচ্ছিল অভীক। মনেমনে নিজেদের নতুন করে পড়বার চেষ্টা করছিল ও। যদিও ও জানে, এ নেহাতই ছেলেমানুষি খেয়াল। তবুও কেন যেন আজ ভাবতে ভালোই লাগছে। স্নেহা এখনও গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এবারে কিন্তু ওর চোখে মুখে বিরক্তি নয় বরং আনন্দের লহমা দৌড়ে বেরাচ্ছে। কপালের একপাশ থেকে কিছু চুল বেরিয়ে এসে ওর নরম গাল স্পর্শ করে দিচ্ছে। সেদিক দেখে ভীষণ হিংসা হয় অভীকের। আগুপিছু না ভেবে এবারে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেয় স্নেহাকে।
“কী করছ কী? ধূর!” বিরক্ত হয় স্নেহা। “দেখছ না কাজ করছি।”
– তাতো দেখতেই পাচ্ছি। তা ম্যাডাম, কফি তো কোল্ড কফিতে টার্ণ নিচ্ছে।
হাসতে হাসতে বলে অভীক। এবার যেন একটু সচকিত হয় স্নেহা। চটজলদি কাপটা হাতে তুলে নিয়ে ওতে চুমুক বসিয়ে নেয়। আর সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট বেঁকিয়ে ফেলে ও।
– এহ! আসলেই একদম ঠান্ডা…
“আরেকটা অর্ডার করব?” অভীকের কথার জবাব আসে চটজলদি
– নাহ! দরকার নেই৷ আবার সময় নষ্ট। আমাকে একবার এমডি স্যারের সাথে কথা বলতে হবে। আগামীকালের এই…
স্নেহা কথা থামিয়ে দেয় হঠাৎ করে। কারণ, অভীক ওর কোন কথা শুনছে না। একদৃষ্টে বাইরে তাকিয়ে কী যেন দেখছে। স্নেহা খানিক অবাক হয়ে অভীকের দৃষ্টি অনুসরণ করে। নীরব এই ক্যাফেটেরিয়ার বরফ সদৃশ স্বচ্ছ প্রশস্ত জানালার ওপারেই অসীমের বিশালতা। নীল অপরাজিতা রঙে ভেসে যাওয়া আকাশের বুকে তখন শরতের কাশের মত নির্ভার মেঘদল নিজেদের এলিয়ে দিয়েছে সুন্দর। পশ্চিমাকাশের কোণে পিঙ্গল বর্ণের ছাপ জেগেছে। যেন কোন মায়াবিনী পরম আদরে তার গলে সাজিয়ে নিয়েছে পরিণয়ের মনিহার। হলদে চাপার মত রং শরীরে মেখে রৌদ্র পরীর দল ডানা মেলেছে আকাশে। কেমন এক জাদুকরী লগ্ন। স্নেহার চোখে মুগ্ধতার আবেশ জাগে। কতকাল এমন করে প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে দেখা হয় না। নীল ক্যানভাসে যেন আবিরের পিচকরি ছিটিয়ে দিয়েছে কোন দস্যিরাজ। রঙধনু রঙে বুঝি হোলি খেলাতে মেতেছে সৌষ্ঠব বারদ কুমাররাজি। আচ্ছা, এই ক্ষণটাকে যেন কী বলে? ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে, কনে দেখা লগ্ন। তিন বসন্ত পূর্বে এমনই কোন এক বিকেলে দুটো হৃদয়ের ডোর বেঁধেছিল অকপটে। বিনা সংকোচে, কোন রকম দ্বিধা ছাড়াই। ভুস করে সেই স্মৃতি ভেসে ওঠে মানসপটে। সেই কৃষ্ণচূড়ার বেদীতল, মরচে লাল রঙা শাড়ি, শ্বেত পাঞ্জাবি, এক গুচ্ছ লালগোলাপ…ঠোঙা ভরা ঝাল চানাচুর, আর ঝাঁঝালো কোকাকোলার স্বাদ, হুড তোলা রিকশায় বসে হাতের পরে হাত…আজকের এই গল্পটার শুরু হয়েছিল সেদিন এভাবেই। স্নেহা ভাবনায় বুঁদ হয়ে পড়ে। সময় যেন আচমকা আজ পিছিয়ে গেল অনেকটাই। নূপূরের ছন্দের ন্যায় চাপা হাসির কলতান আচানক কানে বাজে ওদের। পাশের টেবিলেই এক প্রেমিক যুগল বসেছে। হাতে হাত রেখে ওরাও উপভোগ করছে অসীমের ক্যানভাসে এঁকে নেওয়া এই মায়া আখ্যান। ওদের দু’চোখের তারায় জেগেছে অনন্য এক দ্যুতি৷ চকচকে নেত্রযুগলে ওরা বুঝি ধরে নিয়েছে গোটা আকাশের বিশালতাকে। আচমকা স্নেহার মনে হয়, অজান্তে নিজেদের মাঝের কিছু একটা বুঝি হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে। স্বপ্নের মনিহার ছুঁয়ে দেখবার এই দৌড়ে সামিল হয়ে বুঝি নিজেদের সবচাইতে মূল্যবান পরশ পাথরের ঔজ্জ্বল্য ফিকে হয়ে আসছে ক্রমশ। অলক্ষ্যে মিঁইয়ে পড়ছে ছোটছোট অনুভূতির সব অনুরণ। স্নেহা দারুণ অবাক হয়। এসব কী আবোত তাবোল ভাবতে শুরু করেছে ও। তবে, আশ্চর্য হলেও সত্য যে, এই মুহুর্তে এই বোকা ভাবনাটাই খুব করে ভাবিয়ে তুলছে কেন যেন। তার সাথে পেয়ে বসেছে এক দুর্নিবার আকাংখা। স্নেহার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে, অভীকের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরতে। তবে অবাক করবার বিষয় হলো, কেন যেন এক আড়ষ্টতা কাজ করছে মনে। রীতিমত ভড়কে যায় স্নেহা। অদ্ভুত তো! কী হচ্ছে কী? হঠাৎ এমন হচ্ছে কেন? বাস্তবতা কী তবে ধীরে নিজেদের মাঝে দুর্ভেদ্য প্রাচীর গড়ে তুলতে শুরু করেছে অলক্ষ্যেই। এভাবেই কী তাহলে…
– কী ভাবছ? অভীকের গাঢ় স্বরে ঘোর কাটে স্নেহার।
“কিছু না।” আলতো উত্তর দেয় স্নেহা। নিজের কাছে নিজেকেই আড়াল করবার চেষ্টা করল যেন।
– দেখেছ স্নেহা, বাইরের আকাশটা… তোমার মনে আছে এমনই একটা…
অভীকের কথা শেষ হয় না। কোমল কন্ঠে সায় আসে এবারে
– মনে আছে, অভীক। সব মনে আছে। কেবল মিলিয়ে নেবার সময়টা কেন যেন হয়ে ওঠে না আর…
অভীক চমকে উঠে স্নেহার দিকে তাকায়। স্নেহার চোখ তখন অভীকের ওপর নিবদ্ধ। তাতে লক্ষ কথার ঊর্মিমালা আঁছড়ে পড়ছে। সেই ভাষা পড়ে নেবার চেষ্টায় মগ্ন অভীক মুগ্ধ হয়ে স্নেহাকে দেখে যায়। আজ কত সময় পর যেন নিজেদের একান্তভাবে পরখ করে নেবার ফুরসত মিলেছে হঠাৎ। অলক্ষ্যে থাকা কারিগর বুঝি মুচকি হাসি হাসছেন আড়ালে।
“একটা কথা বলব?” যুগল প্রশ্ন বাতাসে ভেসে আসে সুন্দর। হেসে ফেলে স্নেহা।
– তুমি বল আগে, চোখ নাচিয়ে বলে ও।
“নাহ! তুমিই বল!”, অনুনয়ের সুর খেলে অভীকের কন্ঠে।
– বাহ রে! আচ্ছা, তবে এস, একসাথেই হয়ে যাক। সেই আগের মতন…
আঙুলের ইশারায় ফেলে আসা গল্পেটা ফের বলে নিতে চায় স্নেহা। প্রস্তাবটা লুফে নেয় অভীক। মুচকি হেসে বলে
– দ্যাটস গুড! ও.কে। দেন, গেট রেডি ফর দ্যাট। ওয়ান, টু, থ্রী… এন্ড…
আর এরপর ছোট্ট শব্দটি বাতাসে প্রজাপতির মত চঞ্চল ডানা মেলে অকপটেই। দ্বৈত স্বরে মিশে যায় একই সুর, তাল আর লয়। আজ বহুদিন পর স্মৃতির সোনালি সুঁতোয় ফের বাঁধা পড়ে সেই চিরায়িত আবেগের নিটোল স্বীকারোক্তি
– তোমাকে ভালোবাসি…