আমার শ্বাশুড়ি মা সত্তরোর্ধ্ব বয়স্কা একজন মহিলা। আমার শ্বশুর আব্বা গত হয়েছেন আজ প্রায় পনের বছর হয়েছে। আর সেটা ঘটেছিল আমার বিয়ের বছর চার পাঁচেক আগেই। আমার শ্বাশুড়ি খুব নরম প্রকৃতির একজন মানুষ। অধিকাংশ সময় চুপচাপ থাকেন। বেশির ভাগ সময় উনি নামাজ কালাম পড়েন, নয় তো ঘুমিয়ে থাকেন। কথাবার্তা বলতে গেলে উনি প্রয়োজনের বাইরে খুব একটা বলেন না।
আমার বাড়ির বারান্দার সাথে একটা লাগোয়া ছাদ আছে। সেখানে আমি কিছু ফুল, সবজি আর পাতাবাহারের চারা লাগিয়েছি। মস্ত বড় এক কলা গাছ তার হাল্কা সবুজ কচিপাতা মেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঠাঁয়। এই জায়গাটাতে প্রচুর পাখি আসে সকালে। বারান্দার মাঝে এক মাটির সানকিতে পানি,পাথর আর কিছু জলজ গাছ দিয়ে তাতে কিছু মাছ ছেড়ে দিয়েছি, সেগুলো পানিতে যখন ছুটোছুটি করে তখন অতটুকু পানিতে যেন প্রবল আলোড়ন তৈরী হয়। আমার শ্বাশুড়ি খুব উপভোগ করেন সেসব। বারান্দার এমাথা থেকে ওমাথা দুটো বাঁশের লাঠি বসিয়ে তাতে নানা রকম লতাগুল্ম ঝুলিয়েছি টবে। ওগুলোর দীর্ঘ সবুজ লতাপাতা যখন শরীর স্পর্শ করে তখন এক অদ্ভুত ভাল লাগাতে মন ভরে যায়। সকালের নাস্তা শেষে আম্মা এই জায়গাটাতে কিছুক্ষণ বসেন। এরপর ধীর পায়ে ঘরে প্রবেশ করেন। ওনার বিনোদন বলতে এতটুকুই।
বারান্দায় উনি যে চেয়ারটাতে বসেন, ওটা আমার শ্বশুর মশাইয়ের সময়কার আসবাব। সেগুন কাঠের এই আরাম কেদারাটি বার্নিশ উঠে গিয়ে চাঁছা ছোলা এক অবস্থায় চলে গেছে। উনি তবুও এই চেয়ারটা কোথাও সরাতে দেন না। ওটাতে ওনার ভালবাসার মানুষের স্মৃতি যে জড়িয়ে! জানি না, আমার অনুমান, হয়ত ঐ পৌরাণিক বিদ্ধস্ত মলিন কেদারা ওনাকে ওনার অতীতের ঝলমলে সোনালী স্মৃতির রাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এটাতে করেই হয়ত উনি অতীতকে আজও ওনার বর্তমানে ধরে রেখেছেন। হয়তো? কে জানে? শুনেছি, আমার শ্বশুর আব্বা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এত সচ্ছ্বল ছিলেন না। তবে জেনেছি, উনি মনের দিক থেকে প্রচুর বৈভবশালী, সৎ, নীতিপরায়ণ একজন মানুষ ছিলেন। অন্যায়ের সাথে আপোষ করা ওনার অভিধানে অনুপস্থিত ছিল একেবারে। সাত ছেলেমেয়েকে উনি অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছেন। রেখেছেন নিরাপত্তা, স্নেহ, মমতা আর ভালবাসার সুশীতল ছায়াতে। ওনার সম্পর্কে যত জেনেছি অজানা এই মানুষটার প্রতি মন থেকে কেবল শ্রদ্ধাই জেগেছে। গড়ে উঠেছে সম্মানের এক আলোকিত উপাখ্যানের অধ্যায়।
যাই হোক, আমার শ্বাশুড়ির সাথে আমার সম্পর্ক বেশ বন্ধুত্বপরায়ণ আর খোলামেলা। ওনার সাথে ধরতে গেলে আমি সবরকম কথাই বলি। উনিও আমাকে ওনার নিজের মেয়ের মতই সবসময়ে দেখে আসেন। ভীষণ ভালবাসেন উনি আমাকে। মাঝে মাঝে কথার ছলে নিজের জীবনের অনেক কথা বলে ফেলেন। ওনার কাছে শুনেছি, ওনার বিয়ে হয়েছিল অনেক অল্প বয়সে। এত ছোট বয়সে একটা মেয়ের তখন হাড়ি পাতিল পুতুল খেলার বয়স। কিন্তু তথাকথিত সমাজ ব্যবস্থার নিয়মের বেড়াজালে জড়িয়ে অনেক অল্প বয়সে ওনার সংসার নামক জটিল ধাঁধাঁর ঘরে প্রবেশ করতে হয়। অনেক ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া করার। কিন্তু জীবন সমর ক্ষেত্রে সে ইচ্ছার ইতি টানতে হয়েছে অনিচ্ছা সত্ত্বেও। এরপর নিজের স্বামীর সংসার গোছানো ছেলেমেয়ে মানুষ করা সর্বোপরি নানা সাংসারিক টানাপোড়েনের মাঝেও স্বামীর সাথে সমানভাবে সব বিষয়ে সাহসিকতার সাথে সাহচার্য দিয়ে যাওয়া…আরও কত যে জীবনের গল্প কথা রয়েছে ওনার জীবন রত্ন ভান্ডারে! তার আর বুঝি কোন ইয়ত্তা নেই। স্থবির এই মানুষটাকে ভাল করে দেখলে আর ওনার কথা শুনলে বুঝা যায় উনি ওনার জীবনসঙ্গীকে কিভাবে অনুভব করেন প্রতিটি ক্ষণে। এমনি এক দিনের কথা। দিনের কাজ কর্ম শেষে ওনার সাথে বসে গল্প করছিলাম। নানা রকমের গল্প। সামনেই আমাদের বিবাহবার্ষিকী। আমার সাহেব প্রায় প্রতিদিনই বলেন পছন্দসই কিছু একটা কিছু নিয়ে নিতে। কিন্তু কি কিনব বুঝতে পারছিলাম না। তাই আম্মাকে মজা করে জিজ্ঞাসা করি
- বলেন তো, আম্মা কি নেয়া যায়?
- নাও না। তোমার কি কিনতে ইচ্ছা করে।
হাসি মুখে উনি কথাটা বললে উত্তর করি
– বুঝতে পারছি না তো।
এবার উনি বলেন
– মা, তোমার হাতে সবসময় পড়ার জন্য সুন্দর কিছু একটা নাও।
আমার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ভাল বুদ্ধি! একটা ব্রেসলেট নেওয়া যেতে পারে। হ্যাঁ। তাই ভালো হবে।বলি
– আম্মা, ভাল বুদ্ধি দিয়েছেন। তাই নিব দেখি।
উনি হাসেন। শ্রান্ত চোখের পাতা বন্ধ করলেন আবারো। একটু চুপ করে থেকে বলি
– আম্মা একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?
– বল না।
চোখ বুঁজেই উত্তর করেন।
– আচ্ছা, বাবা আপনাকে আপনার জীবনে প্রথম কি উপহার দিয়েছিল?
কুঁচকানো চোখ জোড়া খুলে গেল ধীরে। সেখানে মনে হয় কিছুটা আড়ষ্ঠতা আর অবাক করা কান্ড লজ্জা দেখা গেল। বেশ মজা লাগল এখনও মানুষ এসব বলতে লজ্জা পায়। আমি আবার বলি
– কি হল? বলেন না, আম্মা?
– মনে নাই।
সলজ্জ উত্তর। আমি খুব মজা পাচ্ছিলাম। তাই আবারো জিজ্ঞেস করি
– মনে ঠিকই আছে। লজ্জা পাচ্ছেন। বলবেন না, তাই বলেন।
- কি বল না বল।
উনি হেসে ফেললেন। হাতের কাছে রাখা একটা ভাঁজ করা কাপড় খুলে অযথা আবারও ভাঁজ করতে লাগলেন সেটাকে। অর্থাৎ উনি সেই রকম লজ্জা পাচ্ছেন। এবারে আমিও হেসে ফেললাম একেবারে। বললাম
- আম্মা, এত লজ্জা পেলে থাক। বলতে হবে না।
কিন্তু এবার মনে হল কিছু বলার প্রস্তুতি নিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
– তোমার শ্বশুর আমাকে একটা আংটি দিয়েছিল যাতে তোমার শ্বশুরের নামের আর আমার নামের প্রথম অক্ষর খোদাই করা ছিল। জান মা, কি যে সুন্দর ছিল সেই আংটিটা! আমার চোখের নীচে ওটার ছবি আজও ভাসে।
ওনার চোখে মুখে অজানা এক শিহরণ দেখতে পাই। এবার বলি
– সেটা কই এখন?
আমার প্রশ্নের উত্তর পাই একটু দেরিতে। মন খারাপের সুরে উনি বললেন
– সংগ্রামের (১৯৭১) সময় ওটা বাড়ি ডাকাতির সময় চলে গেছে। বুঝলা মা! আমার আর অন্য কোন কোন কিছুর জন্য অত খারাপ লাগে না। যতটা ঐ আংটিটার জন্য লাগে।
দেখতে পেলাম, বয়সের ভারে দুর্বল হয়ে পড়া চোখের চাহনি আর কন্ঠে বেদনার করুন সুরের ছাপ স্পষ্ট। মনটা কেমন যেন খুব খারাপ হলো আমার। ওনার ঠান্ডা নরম হাতটায় হাত রেখে বলি
– আপনার মনটা খারাপ করে দিলাম আম্মা
– না রে, মা! তুমি মন কেন খারাপ করাতে যাবে? তাকে আমার সবসময়ই মনে হয়। সবসময়! শুধু মনে হয় আজকে যদি মানুষটা থাকত…
শূণ্য দৃষ্টিটাতে কেমন অব্যক্ত বোবা কষ্ট দেখা গেল। আমি ওনার হাত ধরে থাকি। জানালা গলে শেষ বিকেলের এক ফালি রোদ্দুর বিছানার ওপর গড়াগড়ি দিচ্ছে। ওনার দৃষ্টি সেই রৌদ্র খেলার ওপর নিবদ্ধ। ওনার চাহনিটা শান্ত, স্থির দেখা গেলেও মনের মাঝে যে বিরহের করুণ ঝড় বইছে তা বুঝতে আমার বাকি রইল না।
কি অদ্ভুত! এই ভালবাসার আবেশ আর মায়া। যে মানুষটা এত কাল ধরে নেই তবুও তার ভালবাসার স্মৃতিকে কতটা নিবিড়ভাবে এই মানুষটা তার বুকে আঁকড়ে ধরে রয়েছে। মানুষটার প্রতি ভালবাসার নিটোল স্পর্শ উনি অনুভব করেন পরিত্যক্ত ঐ কেদারাতে, ওনার অস্তিত্বে, ওনার স্মৃতিতে। কি অপরূপ এই অনুভুতি! এটাই তো ভালবাসার সার্থকতা। এর অমোঘ সৌন্দর্য। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে থাকি। চামড়ার ভাঁজে ডেবে থাকা মুখটাতে আজও ভালবাসার রঙ খেলতে দেখা গেল। কি সুন্দর আর পবিত্র অনুভুতি। দেখি আর ভাবি। এভাবেই, হ্যাঁ, ঠিক এভাবেই বেঁচে থাকুক যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর সব ভালবাসার গল্পগুলো। এতটাই এদের জয়জয়কার হোক যেন, বর্তমানের ঘৃণা ভরা এই পৃথিবীতে ভালবাসার দ্যুতির কাছে ঘৃণাও লজ্জা ভরে তার দৃষ্টি নামিয়ে নিতে বাধ্য হয়।