বিবেক

“শুভ্র পালক” সংকলন গ্রন্থ “নব সাহিত্য প্রকাশনী” প্রকাশকাল- অমর একুশে বইমেলা ২০২১

by soniatasnim
অফিস থেকে বের হয়ে চৌরাস্তার মোড় হয়ে মেইন রোডে তাড়াতাড়ি পৌঁছুতে গেলে এই গলিটা দিয়ে শর্টকাট রাস্তা মাপতে হবে। আর গলিতে ঢুকতে না ঢুকতেই ভুতুরে লোডশেডিং! মুহুর্তেই আলোকজ্জ্বল ব্যস্ত নগরী ছেয়ে গেল নিকষ কালো অন্ধকারে। আঁধার এত বাজে জিনিষ রে বাবা! গা ছম ছম করে ওঠে কৌশিকের। ও দ্রুত পা চালায়, আর আঠারো কুড়ি গজ পরেই মেইন রোড। সেখান পর্যন্ত যেতে পারলেই হল। ব্যাস! আর ভয় নেই কোন। কৌশিক পায়ের গতি বাড়িয়ে দেয়। যাকে প্রায় সেমি দৌড় বলাই চলে। অকস্মাৎ, কৌশিক ওর পাশে আরেকটি অস্তিত্ব টের পায়। আশ্চর্য! এই শ্রীমানের আবার আগমন ঘটল কখন? ভয়, উৎকন্ঠা আর ভাবনার রাজ্যে কৌশিক এতই তলিয়ে ছিল যে, ওনাকে টেরই পায় নি। যাক। আসুক গিয়ে। রাস্তা তো আর কৌশিকের একার নয়, এখানে যে কেউ, যে কোন সময়ে আসতে পারে। পরমুহুর্তে ভয়ে আবার সিটিয়ে যায় কৌশিক। ভাবে, চোর ফোর বা হাইজ্যাকার নয় তো? অন্ধকারে দাঁও মারতে এসেছে। ধুর! এত ভয় পেলে কি চলে?
- ভাববেন না, মশাই। চোর, হাইজ্যাকার নই কোন। একেবারে নিপাট ভদ্রলোক।
চমকে ওঠে কৌশিক। আগুন্তুক তার মনের কথা জানল কি করে? পরক্ষণেই আবার শুনতে পেল
– কি করে মনের কথা জানলাম, তাই ভাবছেন তো? ওটা নিছকই অনুমান। ভয় নেই।
– আপনি এই দিকে কোথায় যাচ্ছেন?
কৌশিক প্রশ্ন করে
- আপাতত: আপনার গন্তব্যেই আমার গন্তব্য। মানে ঐ চৌরাস্তার মোড়।
– ওহ। থাকেন কোথায়?
– তা…আল্লাহর দুনিয়ায় সব জায়গাতেই থাকা হয়।
– কেমন হেয়ালি উত্তর! আবার পাগল টাগল নয় তো? কিংবা অজ্ঞান পার্টি? ভুলিয়ে ভালিয়ে কার্য সিদ্ধির মতলবে রয়েছে?
- হে !হে! আবারও ভয় পাচ্ছেন? ভয়ের কিছু নেই। আমি কোন ঝামেলায় যাই না। ঐ যে বললাম না, একদম নিপাট ভদ্রলোক।
রাস্তার পেছন দিক থেকে সাহায্যের জন্য এক নারী কন্ঠের আর্ত চিৎকার শোনা যায়। লোকজন যা এই পাশটায় আছে তা বেশিরভাগ ভয়ে উল্টোদিকেই ছুটছে আর বাকিরা মজা দেখছে। আসল কথাই বলা হয় নি, পেছনে লোডশেডিং এর ফায়দা নিয়ে কয়েকজন দুর্বৃত্তকারী এক কিশোরীকে ইভ টিজিং করছে। বাজে নোংরা মন্তব্য করছে আর তার মধ্যে একজন তো কিশোরীর ওড়না ধরে রীতিমত টানাটানি করছে। ষোল সতের বছর বয়স হবে মেয়েটার। মনে হয় এই দিকে কোথাও প্রাইভেট পড়তে এসেছিল। বিপদ যে কিভাবে কার জন্য কখন ওঁত পেতে থাকে! কি যে আছে মেয়েটার কপালে আল্লাহ জানে। আর ঐ দুর্বৃত্তদের মাঝে আবার বাকি দুজন চাকু হাতে রেখেছে। এমন নিকষ আঁধারেও কেমন চকচক করছে ওটা। ওরা সবাইকে হুমকি দিয়ে চলেছে, কেউ সামনে এগুলে তার ঠিকানা হবে সোজা পরপারে। অগত্যা দৃশ্য অবলোকন করা ছাড়া সবার আর কি বা করার আছে? নিজের জীবনের প্রতি মায়া তো সকলেরই রয়েছে। কৌশিক অফিস থেকে বেরিয়ে এদিকটায় এসেছিল শর্ট কাট ধরবে বলে। কে জানত, এসে এই দৃশ্যের মুখোমুখি হতে হবে। মেয়েটার চিৎকার শোনা যায় আবার। কি ব্যাপার? কেউ সাহায্যর জন্য এগুচ্ছে না কেন? দেশটায় শুরু হলো কি? কোন পুরুষ মানুষ বা সাহসী কেউ একজন নেই নাকি এই মেয়েটিকে পরিত্রাণ করবার জন্য!
– হা !হা! হা! মেয়েটিকে কারও সাহায্য করবার কথা ভাবছেন? নিজেও তো বেশ জোয়ান গাট্টা পুরুষ মানুষ। যান না, নিজেই নেমে পড়ুন তবে।
কিছুটা উপহাসের ছোঁয়া পাওয়া গেল কথাতে। বিরক্ত হয় কৌশিক বলে
– আচ্ছা লোক তো আপনি। নিজেও তো লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছেন। তা আপনি যাচ্ছেন না কেন?
– হা !হা !হা! ভালো বলেছেন। বাড়িতে আমারও বউ বাচ্চা আমার পথ চেয়ে বসে রয়েছে। আমার কিছু হলে তাদের কি হবে? আর তাও ছাড়ুন। আপনার মত আমারও তো জানের মায়া আছে। ওটাই যে আসল। পরিবার তো হলো গিয়ে আত্মরক্ষার ঢাল।
- কথা তো ঠিকই তাই না। আমি প্রতিবাদ করেই বা কি লাভ? আমি এমন কোন বাহাদুরের ব্যাটা যে আমার কথায় ওরা বাপ বাপ করে পালাবে। আর তাছাড়া আমি বা কেন? প্রথমে অন্য কেউ তো এগুতে পারে না কি? কেন অযথা বলির পাঠা হতে যাব? জীবন তো একটাই তাই তো? কি দরকার অপঘাতে মরে যাওয়ার?
– হুম। ভালই বলেছেন। ঠিক তো কি দরকার অযথা নিজের জীবনকে বিপদে ঠেলে দেবার? বাকিরা তো আছেই। তবে সবার সামনে যে বড় রক্ত গরম করা নীতিবাক্য, ফেসবুকে জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস আর চায়ের টেবিলে প্রতিবাদের ঝড় তোলা ভাষণ যখন…
- আরে সেসব ছাড়ুন মশাই। ওসব সবাই বলে। বলা আর করবার মাঝে তফাত রয়েছে। ইটস নট এ্যা কাপ অফ টি কিংবা যত গর্জে তত বর্ষে না, তা একে যেভাবেই দেখুন না কেন। আমাদের মত ছা পোষা মানুষের প্রতিবাদে কিছু হবার নয়। বুঝলেন? অযথা নিজের প্রাণ খোয়ানো।
- এক্কেবারে ঠিক বলেছেন। খাঁটি কথা। তবুও কি জানেন তো … মানে অপরের দিকে না তাকিয়ে নিজেও একটু উদ্যোগী যদি…
– শুনুন, মশাই! জীবনটা রঙিন জগতের পর্দা কিংবা উপন্যাস নয় কোন। বাস্তবতায় আসুন। আর প্রতিবাদ যে করব না তা তো বলিনি। দশ জন এগিয়ে এলে সঙ্গে থাকবার কথা ভাবতে পারি। কিন্তু একা! মাফ করবেন। প্রশ্নই আসে না। আর আপনার কি সমস্যা বলুন তো? কখন থেকে বাজে বকে যাচ্ছেন। এতই যখন হিরোগিরি করার শখ তখন নিজেই যান না, আমার মাথা কেন খাচ্ছেন?
– হে! হে! যা বলেছেন। একেবারে যেতে যে চাচ্ছি না তা নয়; যাওয়ার সাহস বা ইচ্ছেটা যে আপনিই দমিয়ে দিচ্ছেন।
চরম বিরক্ত হয় কৌশিক। রাগান্বিত ভাবে আগুন্তুককে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে ও
– মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি?
– হে! হে! মানে…
কথা শেষ না হতেই হঠাৎ বিকট আর্তচিৎকার পেছন থেকে ভেসে আসে। চমকে ওঠে কৌশিক। মেয়েটিকে কি ওরা খারাপ করে কিছু করল? বেঁচে আছে তো মেয়েটা না কি …
- থামবেন না মশাই। জোরে পা চালান আরও। কে জানে? বিপদ এ পর্যন্ত আসতে কতক্ষণ? ছুটুন, ছুটুন। কি দরকার ওসব ঝামেলাতে পড়ার? পরে পুলিশ কেস হলে আবার স্বাক্ষী দেবার ঝামেলা। ওতেও তো বিপদ! সত্যি বললেই তো খতম। এদের লেজের তো শেষ নেই। বুঝলেন না!
কথা শতভাগ সত্য। কৌশিক এবার রীতিমত দৌড়াতে থাকে। রাস্তায় পাবলিকের ভিড় বাড়ছে। সবাই উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা বলছে। কিছু তো খারাপ একটা কিছু ঘটেছেই। ফাঁকা দু রাউন্ড গুলিও বুঝি ছুড়ল কেউ। একজন লোক চিৎকার করে বলছে লাশ! লাশ! মেরে ফেলেছে তাহলে কি ঐ কিশোরীকে? আহা! কোন বাবা মায়ের বুক যে খালি হলো আবার?
- আরও জোরে পা চালান রে ভাই।
হ্যাঁ। ঐ তো প্রায় পৌছে গেছে ওরা। আর এক গজের মত দূরে মেইন রোড। একটা পুলিশ জীপ বাঁক নিয়ে ঢুকল গলিতে। আরও ঘন্টা খানেক আগে এলে কি হতো? যাক গে, এসব ভেবে লাভ কি?
– এসব মাথা থেকে একদম ঝেড়ে ফেলুন। ঐ যে বাঁদর মূর্তি তিনটে আছে না, নিজেকে একদম ওমন বানিয়ে নিন মশাই। কিছু দেখব না, বলব না, শুনব না।
বড্ড বেশি বকে লোকটা। এতদূর রাস্তা দৌড়ে রীতিমত হাঁপাচ্ছে কৌশিক। ঐ তো নয় নম্বর বাস আসছে। যাক শান্তি।
– আচ্ছা মিলি যখন বড় হবে, কিংবা শিলা যখন রাস্তায় কোন কাজে বেরুবে এমন ঘটনা তখন ওদের সাথে ঘটলে তখনও কি ঠিক এমনটাই চুপ করে থাকবেন?
চমকে ওঠে কৌশিক। কে বলল কথাটা? পাশের আগুন্তকের হাসি কানে বেজে ওঠে ওর।
- চলি। মশাই। অন্ধকারে আপনার সাহচার্য বেশ ভালো লাগল। যেকোন সময় ইলেকট্রিসিটি চলে আসবে। চলি তাহলে আজ। ভালো থাকবেন খুব।
কৌশিক এবার মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেসা করে সেই অচেনা পথ সহচরকে
– কে আপনি, ঠিক করে বলুন তো? আমার স্ত্রী শিলা, আর মেয়ে মিলি ওদের কথা আপনি কি করে জানলেন? আপনি কি আমাদের কাছাকাছি থাকেন? বা আমরা কি কেউ একে অপরকে চিনি?
- হা! হা! হাসালেন মশাই। আমাকেই চিনলেন না! আমি যে আপনার ভেতরেই বাস করি।
– মানে?
- মানে? আমি … আর কেউ নই। আপনার বিবেক। বিবেক মাত্র।

Related Posts

Leave a Comment