আজিমপুরের দিকে ছুটে চলা প্রশস্ত মেইন রোডের হাত ধরে যে যাত্রী ছাউনিটা রয়েছে, ওটার সংকীর্ণ আশ্রয়ে অনেকক্ষণ হলো দাঁড়িয়ে রয়েছি। উৎসুক দৃষ্টি বিপরীত দিক থেকে দৌড়ে আসা সব দানবাকৃতির বাসের ওপর ঠিকরে পড়ছে। রঙচঙা, ম্যাটমেটে ধ্যাড়ধ্যাড়ে সব চার চাকার যানগুলোর মাঝে নয় নম্বরের দেখা পাওয়াকে এক রকম অমাবস্যার চাঁদ বলেই মনে হচ্ছে এখন। ফুটপাতের এক কিনারার ইট পাটকেল কিছু ধসে পড়েছে রাস্তার ওপর। লাল রঙা এক কুকুর সবের ফাঁকে ফেঁসে থাকা এক বিস্কিটের চকচকে মোড়কে মুখ ডুবিয়ে আহার খুঁজে যাচ্ছে। রোডের মাঝ বরাবর যে প্রকান্ড বট গাছটা শাখাপ্রশাখা মেলে ধরেছে ওটার নিচে বসে রয়েছে এক বৃদ্ধ। পরণে শততালি দেওয়া বসন। বিচিত্র তার রঙের সমাহার। ময়লার আস্তর জেগে উঠেছে সেখানে। কাঁচাপাকা দাড়ি ওর মুখ বেয়ে গন্ডদেশ ছুঁইছুঁই করছে। মুখের চামড়ার আচ্ছাদনে জেগেছে অভিজ্ঞতার শত ভাঁজ। ওদের কোলে জমেছে শিশির বিন্দুর মতো ঘাম। বুড়োর গলায় গামছা দিয়ে বেঁধে রাখা এক হারমনিকা। থেকে থেকে ওর ওপর বর্ষীয়ান বুলিয়ে নিচ্ছে ওর শীর্ণ হাত। আর তাতে বেজে ওঠা মূর্ছনা কেমন কর্পূরের মতো মিলে যাচ্ছে হাওয়ায়। এক মনে দেখে যাই কতক্ষণ ওকে। ওর সামনে রাখা বেঁকে যাওয়া এ্যালুমুনিয়ামের থালটা লক্ষীর আর্শীবাদ পুষ্ট হবার অপেক্ষায়। হয়তো আজ দিনশেষের এই সঞ্চয়টুকুতে ঐ বয়োজ্যেষ্ঠ্যের মুখের হাসি, এই নশ্বর জীবনের কিছু আনন্দ মিলে যাবে সুন্দর। একটা কালো রঙা গাড়ি হুস করে চোখের সামনে দিয়ে বেড়িয়ে যায়। উৎকট ইংরেজি গানের ভলিউম চড়িয়ে বর্ষা উপভোগ করছে ড্রাইভিং সীটে বসা একটি ছেলে। এ কী চালক না নাকি মালিক? কী জানি? মেকি এই জীবনে আজকাল আসল নকলের পার্থক্য গড়ে তোলাই যে দায়। কিচিরমিচির ছন্দে ছুটে যাওয়া রিক্সার বর্ণিল প্লাস্টিক পর্দারা প্রজাপতির মতো বাতাসে নিজেদের ভাসাতে চাইছে। অদূরেই এক হকার বৃষ্টিমাতার আর্শীবাদ থেকে ওর পসরা রক্ষা করবার জন্য তড়িঘড়ি করে আচ্ছাদন টেনে নিচ্ছে ওসবের ওপর। উল্টো দিকে মুদির দোকানটার সাটার আধাআধি করে টেনে নামানো। ওটার ভেতরে গিজগিজ করছে মানুষ রূপী কীটের দল। মোবাইলে কথা কাটাকাটি করতে করতে পথ পাড়ি দিচ্ছে এক পথচারী। ওর হাতের সদাই এর থলে থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা মাছের লেজের কিছু অংশ। সেদিকে দেখে খেয়াল হলো, বাসায় ফিরতে কিছু ধনেপাতা আর কাঁচামরিচ নিয়ে যেতে বলেছিলো রমা। তা সে গলির মুখের সুরেশের দোকান থেকে মিলে যাবে বিলক্ষণ। তবে মনে পড়াতে রক্ষা। নচেৎ আজ ঠিক…. চিন্তার সুঁতোর জট পাকাতে দেই না আর। সকাল থেকেই ঝিরঝির বর্ষণ কুমারী নগ্ন পায়ে মাড়িয়ে নিচ্ছে শহুরে রাজপথ। আষাঢ়ের বারো তারিখ হতে চললো। শহরের ধূলো ওড়ানো বাতাসে তাই যখন তখন লাগে বৃষ্টি জলের সোঁদা স্পর্শ। আপিস থেকে বেরিয়ে এই অবধি আসতেই টিপটিপ অভিমানী আঁখি জলে কাক ভেজা হয়ে গিয়েছি পুরোদস্তুর। ইস! জব্বর ভেজা হয়ে গিয়েছে আজ আসলেই। শীত করে ওঠে আচমকা। ঠান্ডা-সর্দি না কাবু করে নেয় শেষে। বাড়ি গিয়েই গরম জলে গড়গড়া আর সঙ্গে এক কাপ ঝাঁঝালো আদা চা একদম আবশ্যক। শার্টের ওপরের বোতাম খুলে নেই। গলায় ঝুলতে থাকা জিবের মতো টাইখানা চুপসে গিয়ে একদম শরীরের সাথে লেপ্টে গিয়েছে। রঙও উঠছে বুঝি। সাদা শার্টে লাল রঙের ছিটেফোঁটা জেগেছে। মনেমনে টেইলার ব্যাটাকে দেখে নেই একচোট। ইচ্ছে হচ্ছে গালির তুবড়ি ছুটিয়ে ওর গুষ্টি উদ্ধার করি। কিন্তু সে আর কী করে সম্ভব? শ্রীমানকে বাগে পাওয়া কী যেই-সেই কর্ম নাকি? তা করতে হলে ছুটতে হবে নিউমার্কেটের দিকে। অগত্যা সেই পরিকল্পনা তো গুরু পুরোই ফ্লপ। তাই ওটার চিন্তা ছেড়ে এবারে এক হাতে ধরে থাকা ব্যাগটাকে ঝাঁকি দেই জোরসে। সিক্ত হাঁসের পালকের মতোই ওটা ওর শরীর থেকে জল ঝরিয়ে নিলো। এই ব্যাগটা কিনেছিলাম আজ বছর তিনেক হয়। রমা কিনে দিয়েছিলো এক বিবাহবার্ষিকীতে। ভালোই সার্ভিস দিয়েছে বাছাধন। খানিক রঙ চটে যাওয়া আর হাতলের কাছে একটু ছড়ে যাওয়া ছাড়া আর তেমন কোন সমস্যা করেনি এই অবধি। ও হ্যাঁ, চেইনটা বদলাতে হয়েছে বার দুয়েক। এই যা। সন্তুষ্ট নজর বুলিয়ে নেই ব্যাগের ওপর। বাম হাত ধরে আসছিলো। হাতে ধরা টিফিন ক্যারিয়ারের ব্যাগটা আস্তে করে এবারে পাশে নামিয়ে নেই। চান্দু গোপালের মতো ওটা চুপ করে বসে থাকে মাটিতে। এবারে খানিক বিরক্ত হই অর্ধাঙ্গিনীর ওপর। আর, হবো নাই বা কেনো? পইপই করে বারণ করা সত্ত্বেও রোজ এক গাঁদা লাঞ্চ ঠুঁসে দেবে হট কেরিয়ারে। আরে বাবা, ক্যান্টিন রয়েছে, ভালো খাবার পাওয়া যায়। দিব্যি আয়েস করে ভূড়িভোজন সমাধা করে নেওয়া এখন অফিসে কোন ব্যাপারই না। তবে এই ক্ষুদ্র বিষয়টা গিন্নীকে বুঝাবার সাধ্যি আর কার? সাধে কী বলে ঘরওয়ালি হয়… নাহ, সে দুনিয়া উল্টে যাক, রমার বাপু ঐ এক কথা। বাইরের ছাইপাশ গিলে পেটের বারোটা বাজাবার কোন দরকার নেই। তা হোম মিনিস্ট্রি আইনে ফাইল পাশ না হলে আর কী করা অগত্যা… আনমনে হেসে ফেলি এবার। রমার মুখটা মনে পড়ে। রাগলে কী ভীষণ মূর্তি হয় ওর! বাব্বা, সাক্ষাৎ যেন ক্রুদ্ধ দেবীর রুষ্ট রূপ! অথচ যখন সাত পাঁকে ওর সাথে জীবন বাঁধি তখন রমা একেবারেই আনাড়ি বধূ। কথায় কথায় ভ্যাবাচাকা খেয়ে যেত খুব। ওর সেই ভীরু লোচনে সময়ের পরিক্রমায় কখন যে অভিজ্ঞতার দিব্য দৃষ্টি মিলে গেলো তা বুঝতেই পারলাম না। এককালে কেঁদে কেটে বুক ভাসানো সেই বোকা দেখো না মেয়েটা আজ একদম পোক্ত গৃহিনী। সময়! আসলেই সময় হয়ও সবচাইতে বড় আপেক্ষক। মানুষকে বদলে দেবার ক্ষেত্রে এর সত্যি জুড়ি মেলা ভার। কথাটা মনে হতেই অগোচরে এক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে পড়ে বুক চিঁড়ে। মনের মাঝে বন্দী বিহঙ্গটা বরাবরের মতোই ডানা ঝটপটিয়ে ওঠে। মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে ওটাকে তাড়িয়ে দিতে যেই না উদ্যোত হয়েছি, অমনি আমার চোখ আটকে গেলো এক টুকরো নীল আকাশের ওপর। হ্যাঁ, নীল আকাশই তো। মর্ত্যে যেন নেমে এসেছে এক ছটাক নীলিমা। পৃথিবী বুঝি পলকেই থমকে গেলো আমার। অপলক হয়ে তাকিয়ে থাকি আমার অতীতের এক খন্ড আয়নার ওপর। কিছুটা ভড়কেও যাই। চোখ রগড়ে নেই খুব করে। কোন ভুল হচ্ছে নাতো আমার? জীবন সমুদ্রের মধ্য স্রোত সাঁতরে নিচ্ছি এখন, আর সবকিছুর মতো চোখের দৃষ্টিটাও ইদানিং বিশ্বাসঘাতকতা করতে চায় বড্ড। এখন কী তেমন কিছুই ঘটছে আমার সাথে? আমার সন্মুখে কী মরুভূমির মরীচিকা নাকি…
– বলুন তো নয় নম্বর বাসটা কটা নাগাদ আসে?
আমার কানে যেন সুডৌল বাহুতে সেজে থাকা রঙিন চুড়ির রিনরিন ছন্দ বেজে ওঠে। নাহ! কোন ভুল নয়, ভ্রম তো নয় মোটেও। চোখ সঙ্গ না দিলেও আমার শ্রবণ শক্তির ওপর মোটেও সংশয় নেই কোন। এই কিন্নর স্বর যে কোটি সুরের মাঝেও আমি খুব চিনে নিতে সক্ষম। এই সে কন্ঠ, যার মিঠে বোলে ঝরে পড়া শত অনুরাগ আমার হৃদয় অলিন্দে কম্পন জাগিয়ে তুলতো তিরতির। তুলতো? শব্দটা নিজের কাছেই কেমন খটখটে মনে হয়। এখনও কী সেই অনুভূতি আমার হৃদয়ে জাগেনি? তবে কী…আসলে এ যে কেবল কন্ঠ নয়, এ যে আমার… কিন্তু আজ এখানে কী করে… আমি হতবিহ্বল হয়ে সেই দিকে তাকাই আবারো। এটা যে জাদুর চাইতেও জাদুকরী! জীবন, আসলে নাটকের চাইতেও নাটকীয়। তা না হলে…
আচমকা সময় বুঝি পিছিয়ে গেলো। নিজেকে আবিষ্কার করি সেই প্রত্যন্ত মফস্বলের কোলে। আমার সামনে দাঁড়িয়ে যেন সেই বিলীন হয়ে যাওয়া “আমি”। সেই আত্মবিশ্বাসী টগবগে তরুণ এক। চোখে যার সমর জয়ের দুর্বার নেশার উন্মাদ জোয়ারের লহমা। গায়ের আলোয়ানে যে আনায়সে মুড়ে নেয় সব দ্বিধা। চরণ যুগল ত্রস্থ কেবল লক্ষ্যে পৌঁছুবার অভিপ্রায় ছুঁয়ে নিতে। সম্মুখে নদীর চরের মতো স্মৃতি ভেসে ওঠে আমার। তখন সবে মাত্র অধ্যাপনার চাকুরীতে যোগ দিয়েছি। জীর্ণ দশায় জর্জরিত এক সরকারি কলেজে। বি.সি.এস এ এক দফাতেই শিক্ষা ক্যাডারে মিলে গেলো ভাগ্যবর। এমনটা অবশ্য ইচ্ছে ছিলো যে তা নয়, ঐ যে কথায় আছে না ভাগ্যের লিখন খন্ডায় কার সাধ্যি? তা নাহলে পক্ষীরাজের ডানায় ভর করে যে তরুণ স্বপ্ন দেখেছিলো ভিনদেশে উড়াল দেবার জন্য সে কীনা..
“আমার পক্ষে তোমার ভরণপোষণ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় যদি তুমি তোমার নিজ সিদ্ধান্তে অনড় থাকো।” সাদা পাতার ওপর ভোমরার মতো কালো কালিতে খোদাই করে নেওয়া বাবার হাতের গোটা গোটা অক্ষরগুলো আজ আবারো ঝাপসা নজরের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠলো। মনের অজান্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে আসে আমার। বাবা মানে কঠোর কোমলতার সংমিশ্রণে গড়া এক সংকর প্রতিমূর্তি জানতাম, কিন্ত মানুষ সত্যি এতটাই কঠোর হতে পারে? বেশ স্মরণে আছে, লাইট পোস্টের ক্ষীণ আলো আঁধারিতে পড়ে নেওয়া সেই চিঠি পড়ে নেবার সময়, শীতের হিমেল চাদর মোড়ানো ঐ রাতেই শপথ নিয়েছিলাম, জীবনে আর যাই করি বাপের হোটেলে আর একদন্ড নয়। নিজের পায়ের তলার মাটিটাকে এখন বলিষ্ঠ করবার সময়টা আমার হয়ে এসেছে। এরপর আদা জল খেয়ে লেগে পড়লুম। রাত দিন কেবল এক জিদ পাগলা ঘোড়ার মতো চেপে বসেছিলো আমার ঘাড়ের ওপর। যে করেই হোক লড়তে হবে, ময়দানে জিততে হবে। আরে এটা কী ভুলে গেলে চলবে যে, আমার ধমনীতেও সিংহ নারায়ন চৌধুরীর শোণিত ধারা বয়ে চলেছে। আর হ্যাঁ। নিজেকে প্রমাণ করবার লড়াইটা উতরেও গিয়েছিলাম খুব। শহরের আঙুল পাকড়ে থাকা ছা-পোষা মফস্বলের কলেজে চাকুরীটা মিলেও গেল আমার। অপরিপক্ক ভীরু সেই তরুণ যেন তার চিরচেনা খোলস উপড়ে ফেলে তখন অন্য কোন সত্ত্বা। আমি যেন ঠিক রেশম পোকা থেকে ডানা মেলে উড়ে চলা প্রজাপতি কোন। চশমার পেছনে লুকিয়ে থাকা ত্রস্থ নেত্রযুগলে তখন আমার আত্মবিশ্বাসের লহমার বিচরণ। শির উঁচিয়ে চলবার সাহসটাও খুব করে শিখিয়ে নিলো সেই অখ্যাত ধূলো ওড়ানো মাটির আঁচল। এখনও মনে পড়ে সেই জীর্ণ কায়ার বিদ্যাপীঠের বেদীতল এখনো চোখের সামনে স্পষ্ট। ড্যাম ধরা শ্রেণীকক্ষে সাজিয়ে রাখা সারিসারি সেই বেঞ্চিগুলোতে বালির আস্তরের ঘ্রাণ আমি এখনো অনুভব করতে পারি। শ্বেত চকের গুঁড়োয় কেমন মেখে থাকতো আমার ঘাম সিক্ত করতল। এক শার্ট আর এক প্যান্ট, এই সম্বল করে রোজ পড়াতে চলে যেতুম কলেজে। অসংখ্য কৌতুহলী চাহনি সেখানে আমার সমস্ত বিদ্যা লেহন করে নেবার লালসায় জ্বলজ্বল করে উঠতো। শান্ত চিত্তে কেবল দেখেই যেতাম ওদের। কেন জানি না এক অদ্ভুত ভালো লাগা অনুভব করতাম ওতে। পরদেশি হবার যে স্বপ্নটা ভঙ্গুর কাঁচের ন্যায় চুরচুর করে ভেঙে গিয়েছিলো তার আফসোসের অনেকটাই কেমন মিঁইয়ে আসলো। রোজকার দিনের এই যাওয়া আসার খেলাটা জমে এসেছিলো বেশ৷ আষাঢ় দিনের মেঘলা আকাশের মতোই স্কুল ঘরের দেওয়ালে সেঁটে থাকা ব্ল্যাকবোর্ড আর তার চারপাশে জট পাকানো সুঁতোর মতো মাকড়সার ঝুলিটাও প্রিয় হয়ে উঠেছিলো খুব। শ্রেণীকক্ষের শ্রী হীন যে অয়ন দ্বার, ওটার প্রান্ত দেশ ছুঁয়ে যাওয়া নাম না জানা যে জংলা গাছটি দাঁড়িয়ে ছিলো, ওটার কচি পত্র পল্লবও যেন নীরবে শুনে নিতো আমার যত বলা, না বলা অনুভূতি। হালকা সবুজ কচুরীপানা ভরা ডোবায় বসে যে ব্যাঙটা গলা ফুলিয়ে ডাক ছেড়ে যেত, ওর বেসুরো গানেও যেন আমার বেদনার করুণ সুর বেজে যেত অকপটে। যা কেবল আমি-ই ছুঁয়ে নিতে পারতুম। সাদা পাতায় খসখস করে যখন পাঠ লিখে যেত সকলে, সেই ফুরসতে ভেবে যেতুম এমন কতশত কথা। তেমনি একদিন নিজ খেয়ালে মজে ছিলাম। মাইনে পেয়েছি তখন দিন দশেক হয়। জীবনের প্রথম উপার্জন। মায়ের মুখটা পূর্ণিমা শশাংকের মতোই বারবার উদিত হচ্ছিলো মানসপটে। মাইনের থেকে কিছু অংশ আর সাথে একটা চিঠি পাঠিয়ে দেব মাকে মনে মনে তাই ভেবে নিচ্ছিলাম। কিন্তু কী লিখব চিঠিতে। ভাবনার জগতে পটু হলেও ভাব প্রকাশের বেলায় আমি ঠিক ততটাই আনাড়ি। তা না হলে এমন বিপাকে কেউ পড়ে কখনো? সেই কখন থেকে বসে আছি সামনে থাকা কাগজ খানায় কিছু আঁকিবুঁকি জুড়ে নিতে, কিন্তু তা আর হচ্ছে কই? বদ্ধ সব আকাঙ্খারা যেন কোন ভুলভুলাইয়াতে ফেঁসে গিয়েছে আমার। কলমের পশ্চাদদেশ মুখে পুড়ে দন্তরাজির আক্রোশ ফলিয়ে নিচ্ছিলাম ওটার ওপরে। আর ঠিক তখুনি…
– স্যার, এই প্রশ্নটা ঠিক…
একটা নরম গলার স্বরে মুখ তুলি। সামনে রেবেকা দাঁড়িয়ে। লাজুক স্বভাবের মেয়ে। বরাবরই চুপচাপ বৈশিষ্ট্যের। ডাগর আঁখিতে মনেহয় কাকচক্ষু জল সবসময় টলটল করে। মুখে যেন সারাটা সময় কুলুপ এঁটে নেওয়া থাকে এই কিশোরীর। কোন প্রশ্ন করলে কেবল মাথাটাই নেড়ে নেবে। মাধবীলতার মতো কাঁধ ছাপিয়ে পড়া সর্পিল বেণীযুগল কেবল দুলে উঠতো শুধু। আমি রেবেকার দিকে তাকাই। ভীরু খরগোশের মতো জড়োসড়ো হয়ে রয়েছে। লেখার ব্যাঘাত ঘটায় মেজাজ চড়ে গিয়েছিলো বেশ। তাই খানিক বিরক্তির প্রসাধন মুখে মেখে নিয়ে বলি,
– একি! কথা? ক্লাসে শোননি ঠিক মতো?
– শুনেছি, স্যার। মৃদু জবাব আসে আমার কৌতুহলের। ভ্রু নাচিয়ে নিয়ে বলি, “তবে?”
– ভুলে গিয়েছি…মাথা নিচু করে উত্তর দেয় রেবেকা।
– কী যা তা বলছ? ইয়ার্কি নাকি? ভুলে গেলে আর কী? দুদিন বাদে এক্সাম। তখন তো আর…
– সরি স্যার। মার্জনা সুর তুলে রেবেকা পিছিয়ে যায় সভয়ে।
– এতো অমনোযোগী হলে পড়ালেখা হয় না। ভালো হয় যদি ঘরে হাঁড়িকুঁড়ি মেজে নেবার কাজে লেগে পড়ো তো।
শ্লেষ্মা উগড়ে দিয়েই আমি চিঠির প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়ি। সেই ঘটনার পর কেটে এরপর গেলো দুদিন। ভুলেই গিয়েছিলাম সে ঘটনা। সেদিন ছুটির পর ক্লাস থেকে রেবেকার চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে যাবার দৃশ্যটা অবশ্য চোখ এড়ায়নি আমার। বলাবাহুল্য রাগ হয়েছিলো খুব৷ রাবিশ, কোথায় যে মনোযোগ থাকে আজকালকার ছেলেপেলেদের, আসলেই? সবার জমা দেওয়া খাতা দুহাতে গুছিয়ে নিতে নিতে ভেবেছিলাম কথাটা।
সে যাই হোক, রোজকার মতো সেদিনও ক্লাস শেষে পা বাড়িয়েছি টিচার্স রুমের দিকে। এর মাঝে দপ্তরী এসে জানায় একজন অভিভাবক দেখা করতে চান। বেলা পড়ে এসেছিলো। ক্ষিদে পেয়েছিলো জব্বর। আধ ঘন্টা পরেই পরের ক্লাসের জন্য ছুটতে হবে। তাই বিশ্রাম কক্ষে বসে নোনা সিঙারায় দু কামড় বসাবো ভেবেছিলাম তাই এমন প্রস্তাবে মেজাজ বিগড়ে গেলো বেশ। না করতে গিয়েও কেন যেন শেষ মুহুর্তে দেখা করবার মনস্থ করলাম সেই আগন্তুকের সাথে। দপ্তরীর কথানুযায়ী, পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম করিডোরের দিকে। কে জানতো, আমার চৌকষ দৃষ্টি তখন এক ইতিহাস ছুঁয়ে নেবার অপেক্ষায় ছিলো। ছোট ছোট পদচিহ্ন এঁকে নিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছেও গেলাম এক সময়। দখিনা হাওয়া তখন ওর আলুথালু আঁচল মেলে দিয়েছে প্রান্তরে। পায়ের গতি থামিয়ে নেই এবার।
– জি বলুন, আমাকে খুঁজছেন?
প্রশ্নটা কেমন কার্পাস তুলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে সমীরণে। আমার ডাকে সম্বিত ফেরে সেই অচেনা মানবীর। পরণে এক টুকরো আকাশ জড়িয়ে সে এবার আমার দিকে ফিরে। আর ফিরতেই চমক। আমি চমকে উঠি। সত্যি বলতে কী আমার তখন মনে হয়েছিলো মহাকাল যেন তার গতি এক মুহূর্তের জন্য থামিয়ে নিয়েছে। চতুর্দিকে নীরব হয়েছে চরাচর। থেমে গিয়েছে পাখির কূজন। গোটা পৃথিবীতে যেন কেবল আমরা দুজন…
– কিছু মনে করবেন না, আপনি কী আসলেই একজন শিক্ষক?
তেজি সুরসুরেলা কন্ঠ যেন তীরের ফলার মতো ছুটে আসে আমার দিকে। কিছুটা হকচকিয়ে যাই। বিব্রতবোধ করি যথেষ্ট। তবুও মুখে স্বাভাবিক ভাব ধরে রেখে বলি,
“মানে?”
– মানে, কোন স্টুডেন্ট পড়া বুঝতে চাইলে বুঝি তাকে এভাবে…
কথা শেষ না করে তীক্ষ নজরে এবার আমাকে দেখে যায় রমনী৷ চোখ তো নয় যেন… রাগের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হলকা বেরোচ্ছে বুঝি ওখান থেকে। খানিকটা থতমত খেলেও সামলে নেই দ্রুত। কপট গাম্ভীর্যের সুধা গলায় ঢেলে নিয়ে বলি,
– মাফ করবেন? কী বুঝাতে চাচ্ছেন?
আমি রেবেকার বড়দি। এবার কোন রকম ভূমিকা ছাড়াই উত্তর এলো ওপর পাশ থেকে।
– তা শিক্ষকতার ভালোই উদাহরণ উপস্থাপন করছেন…
মিছরির ছুড়ি একেবারে। রেবেকা, নামটা শুনতেই মস্তিস্কের বদ্ধ প্রকোষ্ঠ উন্মুক্ত হলো সহসাই। সেই নিপাট পান পাতার মতো মুখখানা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। একটা তাচ্ছিল্যের ভাব মুখে ফুটিয়ে তুলে বলি,
– ওহ! বোনের তদ্বিরে এসেছেন তাহলে?
বিপরীত অস্তিত্ব তার সমস্ত অসন্তোষ যেন ওর ভ্রু যুগলের মাঝে গুছিয়ে নিলো।
– কী বললেন? তদ্বির বলতে কী বুঝাতে চাইছেন? মানছি, ও একটু দুর্বল প্রকৃতির ছাত্রী। কিন্তু কারো আত্মবিশ্বাস দুমড়ে দেওয়াটা কী শিক্ষাদানের পর্যায়ে পড়ে?
“দেখুন…” আমার কথার শেষ হয় না। ঢংঢং করে নেক্সট পিরিওডের ঘন্টা বাতাসকে হঠাৎ ভারী করে তুললো।
– ক্ষমা করবেন। আমার ক্লাস আছে এখন। চলি তবে আজ। দুঃখিত আপনার পুরো কথা শোনা হলো না। আর একটা কথা, পাঠদানের ব্যাপারে আশাকরি কারো থেকে কোন রকম জ্ঞান ধার করবার প্রয়োজন নেই আমার…
কথাটা শেষ করে এবার গতি ঘুরিয়ে নেই। দুপুরের আলতো সমীরণের উষ্ণ চাদর মুড়িয়ে যখন চলতে শুরু করেছি তখন বেশ বুঝতে পারছি এক জোড়া উৎসুক রাগী নয়ন আমার দিকে নিবদ্ধ হয়ে রয়েছে। স্বভাবতই আমার এখানে রেগে যাওয়াটাই সমীচীন তবে আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম মনের মাঝে কেমন একটা অন্যরকম ভালো লাগার অনুভূতির পরশ ছড়িয়ে যাচ্ছে।
——–
এরপর কেটে গিয়েছে আরো কিছু মাস। আজ মাস খানেক হয় রেবেকাকে গ্রামারের পাঠ পড়াচ্ছি। বড্ড কাঁচা মেয়েটা এই ব্যাকারণের দৌড়ে। এই পার্টিসিপল আর জিরান্ডের মতো ক্ষুদ্র ব্যাপারটা ওর নিউরনে কোন রকম কম্পন তৈরী করতে একদমই সক্ষম হচ্ছে না। এমনিতেই ব্যাচ পড়ানো হয় না আমার। কেন যেন ওসবে কোন আগ্রহ জাগে না। তবুও এই রেবেকা মেয়েটাকে…
– আমার বোনটাকে আপনার হাতে তুলে দিলাম। গড়ে পিটে যা গড়বার গড়ে নিন। তবুও ব্যকারণের বেসিকগুলো ওর মাথায় ঠুঁসে দিন দয়া করে। আমি তো রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠেছি।
কথাগুলো বলবার সময়ে সুশ্রী মুখটাতে বিরক্তির আভা জেগে উঠে কিছুটা।
– স্বীকার করলেন তবে আমার দক্ষতার দোষ ছিলো না কোন?
আমার তীক্ষ কথার তীরের ফলার খোঁচায় এবার বুঝি একটু লাজুক লালিমা খেলে গেলো প্রতিমার অবয়বে। ঘাড় নিচু করে নেয় রেণু। ওর উন্মুক্ত হয়ে পড়া ফর্সা গ্রীবাদেশে নিলজ্জের মতো জড়িয়ে রয়েছে স্বর্ণের এক খানা চেইন।
– বা রে! আমি কী তেমনটা বলেছি আপনাকে?
এক হাতে শাড়ির আঁচল খুটে নিতে নিতে বলে রেণু। ঝিরিঝিরি বাতাস খেলে যাচ্ছে ওর মেঘকালো কুন্তলে। আমি বিমোহিত হয়ে পড়েছিলাম একটু। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে ছিলাম শুধু।
– কী হলো? বললেন না যে?
চমক ভাঙে আমার। বৈকালি বাতাস মাতিয়ে তুলছিলো পাখির কূজন। সেই মিঠে কনে দেখানো রোদের এক ছটাক আদর বুলিয়ে দিচ্ছিলো রেণুর চিবুকে। তন্ময় হয়ে কোন অজানা মোহে ডুবে যাচ্ছিলাম ক্রমশ। অপ্রস্তুত ভাব কাটিয়ে নিতে আলতো করে শুধোই, “কী বলবো?”
– বলার কী আসলেই কিছু নেই আপনার?
সলজ্জ সেই কথার সাথে ধীরে ধীরে মিশে যেতে শুরু করলো কী এক অজানা অনুরণ৷ আর ক্রমেই সেই অনুভূতি কখন যে হৃদ সেতারে পরিণয় রাগের ঝংকার তুলে নিলো সেটা বুঝতেই পারলুম না। দিবা-নিশির সঙ্গম খেলাকে আমি প্রতিনিয়তই নব নব রূপে আবিষ্কার করতে থাকলাম। প্রতিক্ষণেই বুঝি…
– প্রহরদা… একটু দেখুন তো হয়েছে কীনা?
রেবেকার ভীরু কন্ঠ শুনতে পাই৷ এই আরেক সমস্যা। মেয়েটার আত্মবিশ্বাসের কমতি প্রচন্ড। কিছু করবার আগেই হার মেনে বসে। দু চোখের জল যেন নদীর বাঁধ ভেঙে নেওয়া জোয়ারকেও হার মানিয়ে দেবে। রেবেকা খাতাটা উঁচিয়ে নিয়েছে আমার দিকে। এই মেয়েকে পড়াবার দায়িত্ব স্বীকার করে অনুরোধে ঢেঁকি গিলে নিয়েছি এক প্রকারের এতে তো কোন সন্দেহ নেই নিশ্চিত। কথা না বলে রেবেকার হাত থেকে খাতাটা নেই। তবে নিজের মনের মাঝে যে প্রশ্নটা ফনা তুলে নিয়েছে এটা নিবৃত্ত করি কী করে? সব সময় এক অজানা তাড়না তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আমায়। পৌষের এই প্রথম প্রহরেও কেনো জানি না গরম ভাব অনুভূত হচ্ছে আমার। স্বস্তি মিলবার আশায় চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দিয়ে শার্টের কলারটা পেছনে টেনে দেই কিছুটা। কাঁধে নরম অনীল স্পর্শ সুখানুভতি জাগিয়ে তুলছিলো বেশ। চোখ মুদে ঢোক চেপে নেই কিছুক্ষণ। বন্ধ নয়ন পাতাতেও দূরদর্শনের পর্দার মতো ভেসে ওঠে সেই মুখ৷ নাহ! শান্তি নেই একদমও। মনের মাঝে যে ঝড় বইছে অনুরাগের তা যে করেই হোক থামাতেই হবে আমায়। আর এজন্য রেণুর মুখোমুখি হওয়া আমার বড্ড প্রয়োজন। ঝট করে দৃষ্টি উন্মেলিত করি।
– আপনার কী শরীর খারাপ লাগছে, প্রহরদা?
রেবেকার দিকে দেখে একটু হাসি। ভয়ে ওর মুখখানি এতটুকুন হয়ে গিয়েছে। কেন যেন ওর ওপর মায়া হয় প্রচন্ড। আজ আর রেগে যাই না। কোমল গলায় বলি,
– নাহ। আমি ঠিক আছি।
“ওহ”৷ একটু আশ্বস্ত হলো বুঝি রেবেকা এবারে। বলতে দ্বিধা নেই, আমার এই অস্থিরতার অন্য আরও একটি কারণ ছিলো বৈকি! কী করে যে এই তুষের আগুন নিবৃত্ত করি তা ঠাহর করতে পারছিলাম না একদমই। সামনে থাকা বুক সেলফের ভাঙা কাঁচে নিজের অস্পষ্ট অবয়ব নজরে আসে। রেবেকা এরই মাঝে আবার ওর খাতায় মুখ ডুবিয়ে নিয়েছে। মাথাটা একদম পৃষ্ঠার ওপর সেঁটে নিয়েছে মেয়েটা। কী করবো? কিছু জিঞ্জেসা করবো কী? গত পরশু লুকিয়ে ওর ইংরেজি ব্যাকারণ বইয়ে গুঁজে দিয়েছিলাম চার ভাঁজে ভাঁজ করে নেওয়া চিঠিটা। বহু কষ্টে ওতে নিজেকে ব্যক্ত করবার প্রয়াস চালিয়েছিলাম। কতটুকু পেরেছিলাম জানি না। তবে যা বলবার ছিলো তা বলেছিলাম সবই। সন্তপর্ণে কাগজটি লুকিয়ে দিয়ে রেবেকাকে বলেছিলাম, রেণুকে বইটি দিতে। চৌষট্টি নম্বর পেইজের অনুশীলনটা করিয়ে দেবার বাহানা করে৷ একদিন গত হলো কই কোন জবাব তো এলো না বিপরীতের। আর কী আশ্চর্য! রেণুরও দেখা নেই এর মাঝে। শীতের সকালের কুয়াশার মতোই ও যেন বেমালুম অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে এই একদিনেই। মাথা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে নেই। বসবার ঘরের দরজায় টাঙানো স্ট্রাইপের পর্দাটা বিমর্ষ ভাবে দুলছিলো। কেমন শূণ্যতায় ভরা জায়গাটা। কেমন অস্বস্তি হয়। চোখ সরিয়ে নেই সেখান থেকে। দেওয়াল ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ ঘরের মাঝের নীরবতাকে আরো বাড়িয়ে তুলছিলো। কেমন গুমোট আবহাওয়া। উফ! নাহ! আর পারা যাচ্ছে না। আগুপিছু কিছু না ভেবে এবারে বলেই ফেলি,
– দিদির কাছে করেছিলে বাড়ির কাজগুলো?
কথাটা বুঝতে রেবেকার বোধহয় একটু সময় লাগলো। নাহ! এই মেয়েটাও যা না! একেবারে…
– ওহ। প্রহরদা, বলতে ভুলে গিয়েছি। রেবুদি ঢাকায় গিয়েছে কাল।
থতমত খেয়ে যাই কেমন। বোকার মতো বলি
– তাই নাকি? হঠাৎ ঢাকায়?
সামনে ঢেকে রাখা পানির গ্লাসের ঢাকনা তুলে নিয়ে ওতে থাকা টলটলে জল ঢেলে নেই গলায়। আচমকা বুকটা যেন মরুর মতো শুকিয় গিয়েছে। যেন রাজ্যের কাঁটাগুচ্ছ কেউ পুড়ে দিয়েছিলো আমার মাঝে। চিন্তার শেকড় ছড়াবার আগেই রেবেকার ঝর্ণার ন্যায় উচ্ছ্বল কলতান শোনা যায়
– জি প্রহরদা, রেনুদির বিয়ের কথা চলছে। পাত্র ঢাকায় থাকে। খুব সুন্দর দেখতে। তবে জানেন, এতদিন বুবু রাজি হচ্ছিলো না একদম, কিন্তু পরশু হঠাৎ কী হলো দুম করে হ্যাঁ বলে বসলো। বাবার সাথে কাল দিদি আগেভাগেই চলে গিয়েছে। আমি আর মা পড়ে যাব। জানেন প্রহরদা…
রেবেকা বলে যেতে থাকে। আর আমি? আমার যেন আচমকা মাথার ওপর গোটা আকাশ ভেঙে পড়েছে তখন। এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় ডুবে গিয়েছিলো আমার ভূবন। আমি ভ্রম দেখছি না তো কোন? চিমটি কাটি নিজেকেই। না কল্পনা নয় বাস্তব সবই। রেণু… রেণুর বিয়ে? আর আমাকে রেণু একবারও বললো না। কেনো? তবে কী এই অনুভূতিটা কেবল আমার নিজেরই ছিলো শুধু? তা নাহলে… কিন্তু ওর চোখে তো অন্য কথা লিখা ছিলো। আমি কী তবে ভাষা পড়ে নিতে এতটাই ভুল করে ফেললাম? বইয়ের পাতার মাঝে গেঁথে থাকা ব্যাকারণ কৌশলে সিদ্ধ চৌকষ প্রহর চৌধুরী জীবনের ব্যাকারণে এতটাই পিছিয়ে গেলো? না, না তা কী করে হয়? রেণু কী অভিমান করেছে তবে আমার ওপর? আমি কী কোন ধৃষ্টতা দেখিয়েছি তবে? কিন্তু কই, তেমন তো কিছু মনে পড়ছে না আমার। তবে? তবে কেন রেণুর এই আচমকা সিদ্ধান্ত? রেণু তো অন্তত আমাকে একটি বার…
– প্রহরদা, দিদি আপনাকে এটা দিতে বলেছিলো। কাল তো আপনি আসেননি তাই…নিন ধরুন। আপনি বসুন। মা আজ পিঠে ভেজেছে। আপনাকে খেয়ে যেতে বলেছে। আমি এখুনি আসছি।
কথাটা বলে ভেতরের ঘরের দিকে দৌড়ে যায় রেবেকা। আমি মূর্তির মতো বসে থাকি ঘরে। একা। সম্পূর্ণ একা। মৃদু বাতাসও যে অতিকায় বৃক্ষকে হেলে দিতে সক্ষম তা নিজেকে দিয়ে সেদিন উপলব্ধি করছিলাম খুব করে। আমার হাতে ধরা রেণুর চিঠি। সাহস হচ্ছিলো না খুলে নেবার আবার এও সত্যি কৌতুহল হচ্ছিলো খুব। কম্পিত হাতে অগত্যা ওটাকে চোখের সামনে মেলেই ধরি এবারে। আর তাতে উন্মোচিত হয় আমার হৃদ শতদলে অংকুরিত হওয়া সেই জটিল প্রশ্নের। সুন্দর করে রেণু সাজিয়ে লিখেছে সেই সরল কৌতুহলের কঠোর জবাবখানি।
” প্রহর,
তুমি যখন এই চিঠিটি পড়বে ততক্ষণে আমি অনেক দূরে। জানি, কী ভাবছো? তবে তুমি যে অনুভূতির পালে হাওয়া ছুঁইয়ে নিতে চাইছো, তাকে আগলে নেওয়া অসম্ভব কাজ। এই আবেগী যাত্রার কোন সফল পরিণতি নেই। হওয়া সম্ভবও না। সম্মুখে যে কেবলই ঝড়। প্রহর ওতে নৌকাডুবি ছাড়া যে আর কোন…
যাই হোক, ছেড়ে দাও ওসব কথা। ভুলে যাও, এমন কোন অধ্যায় তুমি কোন একসময় লিখতে শুরু করেছিলে জীবনে। জীবনের অনুরাগের স্রোত আমাদের একই দিকে বয়ে গেলেও বাস্তবতা আমাদের একই লহমায় ভাসিয়ে নেবে কোনদিন। কেন বুঝেও বুঝতে চাইছো না যে অনুভূতির এই তীর যে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যাবে চিরকাল। তুমি আবেগের বশবর্তী হয়ে ভুলে যাচ্ছ আমাদের জীবনের কঠিণ সত্যটা। যাকে ডিঙিয়ে নেবার অকাট্য যুক্তি, সাহস বা সাধ্য কোনটাই আমাদের নেই। তাই আজ…। আমার আর কিছু বলার নেই। আশাকরি তোমার জিজ্ঞেসার জবাব তুমি পেয়ে গিয়েছো। তাই খুব ভালো থেকো।
ইতি-
….রেণু।
স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকি। বলার মতো আর যে কিছুই নেই। সব কথার ইতি যে রেণু একাই টেনে নিয়েছে। চোখের কোল ভিজে ওঠে অজান্তেই। রেণুর কথাটা শেলের মতো বিঁধেছে হৃদয়ে। আসলেই তো সত্যি, হৃদয় মিললেও আমাদের মাঝে বাস্তবতার ব্যবধান যে অনেক। অনুরণের এই ফারাকটা যে বিস্তরের চাইতেও ব্যাপক। কারণ, আমি হিন্দু, রেণু মুসলিম। আবেগ অনুমতি দিলেও ধর্মের মতাদর্শ আমাদের মিলতে দেবে না কোনদিন। নাহ… এই ভালোবাসার কোন পরিণতি নেই কেবল নিঃস্ব হয়ে যাওয়া ছাড়া। রেণুর চিঠিটা ভাঁজ করে বুক পকেটে নেই। আর সেই দিনই ধীরে সুঁতো টেনে নেই আমার প্রণয় কাব্যের। বিরহের চিতায় মুখাগ্নি করে নেই আমার প্রথম ভালো লাগার আবেগের শবখানি।
তারপর পেড়িয়ে গেছে কতদিন। সময় স্রোত পাড়ি দিয়ে জীবন তীর নোঙর করেছি আজ এই বন্দরে। প্রাণহীন, রূক্ষ শহর, কালো সীসায় ভরা এর ভারী বাতাসের আর্তনাদে এমন কত অসমাপ্ত ভালোবাসার গল্প আজও নিভৃতে ভিজে যায় নোনা চোখের জলে। হ্যাঁ। আকাশ দেখি এখনো। তবে সেদিনের মতো নীলিমা ছড়ায় না আর মনে। সংসার সমুদ্রে জাল ফেলেছি। দায়িত্বশীল স্বামীর ধর্ম পালন করছি। প্রেমময়ী স্ত্রী, ফুটফুটে আদুরে একখানা কচি মুখ তরুলতার মতো উঁকি দিয়েছে জীবনের শ্যামল বাগিচায়। বেশ আছি। সুখে আছি। দুঃখ বেদনা, আনন্দ, ছোটছোট খুনসুটি সব মিলিয়ে বিন্দাসই আছি। তবুও মনের মাঝে কিসের এক ঘুনপোকা যেন কুড়েকুড়ে খেয়ে যায় আমায় প্রতিনিয়ত । মনের ভুল ভেবে ওটাকে উড়িয়ে দিতে চেয়েছি কতবার। কিন্তু চাইলেই কী আর সম্ভব সব কিছু? বলাটা যত সহজ করে নেওয়াটা যে ততটাই কঠিণ। দীর্ঘশ্বাসকে লুকিয়ে নিতে শিখে গিয়েছি এখন বেশ৷ বুকের পাঁজরে হাসফাঁস করতে থাকা ফুসফুসে ভীষণ ক্লান্তি জেগে ওঠে ইদানীং। তবুও চলছিলো জীবন জীবনের মতোই। মেনেই তো নিয়েছি নিয়তির সিদ্ধান্ত। রেণুর কথা মতোই মুছে দিতে চেয়েছি সেই ঝলমলে অধয়ায়টুকু। তবে? তবে আজ কেনো আবার…
এই তো আমার থেকে একটু এগিয়ে গেলেই রেণুর নাগাল মিলে যাবে। ফের বুক ভরে নেওয়া যাবে প্রিয় সেই ঘ্রাণ। আবারো…
“আচ্ছা, রেণু, তুমি কেমন আছো? শুনেছিলাম, তুমি ঘর পেতে নিতে পা বাড়িয়েছিলে সেদিন এক অজানার পথে। ভালোই করেছিলে। আবেগ আর বাস্তবতার মাঝে যে বাস্তবতাকেই মেনে নেওয়া শ্রেয়। তবে সত্যি করে বলো তো, তুমি কী আমাকে এখনো ভাবো না? বিলীন হয়েও কী আজো অবশিষ্ট নই আমি তোমার মাঝে? নাকি আমি তোমার কাছে কেবলই এক অনাকাঙ্ক্ষিত অতীতের নাম? না, ভেবো না তুমি অত। বলতে পারো, সত্যটা তুমি আমায় অকপটে। কথা দিচ্ছি, সেদিনের মতো আজও মাথা পেতে গ্রহণ করবো তোমার সিদ্ধান্ত। বেশ, বাদ দাও এখন এসব কথা। তা তুমি এখন খুব ভালো আছো নিশ্চয়ই। এতদিনে তুমিও বুঝি কারো পোক্ত ঘরণী হয়ে উঠেছো? দিব্যি সামলে নিচ্ছো সব। সত্যি! তোমায় দেখে মনেই হচ্ছে না, তুমি এতটুকু বদলেছো? সেই ছিপছিপে গড়ন, সাগড়ের ঢেউ এর মতো চুল…এই রেণু, তুমি কী আমার সেই…
এমন আরো কত কথা যে বলে যাচ্ছিলাম। নিজেকে বেশ নির্ভার মনে হচ্ছিলো। কত দিন! আজ কতটা দিন পর হৃদ পিঞ্জরে বন্দী শব্দরাজি ডানা মেলে উড়তে চাইছিলো শূণ্যে। তবে তা হবার কী জো আছে আদৌ? আজ আবারো ঘটলো সেই ছন্দপতন।নাহ! পরিণতি পায় না আমার অব্যক্ত কথামালা। কটকটে হলদে রঙা ন’ নম্বর বাসটা যে চলে এসেছে অবশেষে। যাত্রীদের ভিড়ে চাঞ্চল্য খেলে যায়। সেই ব্যস্ত ভীড়ে রেণুও কেমন ভেসে গেলো অবলীলায়। আমি পা বাড়িয়ে নিতে গিয়েও থেমে যাই। থাক না, কী দরকার? জীবন যাত্রায় যেখানে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি সেখানে এই ক্ষণিকের যাত্রা পথে আর মায়া বাড়িয়ে কী লাভ? আমাদের নিয়তিতে যে অসম্পূর্ণটাই বিধান একমাত্র। রেণু হারিয়ে গিয়েছে ভীড়ে। আমার দৃষ্টির নাগালের বাইরে। বাস ছেড়ে দিচ্ছে। প্রবল ঝাঁকুনিতে ওটার হাতির মতো শরীরটা নড়ে উঠছে। আর তখুনি দেখি জানালার কাছে রেণু বসে। উদাসী দৃষ্টি ওর অন্তরীক্ষ চিঁড়ে দিচ্ছে বুঝি। আচ্ছা, কী খুঁজছে ও সেখানে? খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার। তবে জানবার যে উপায় নেই কোন। ভয়ংকর বধিরতা গ্রাস করে নিয়েছে আমায়। আমি অসহায়ের মতো দেখে যাই। জীবন যেন আরো একবার প্রহসনের খেলা খেলে নিলো আমার সাথে। বৃষ্টির জলের সাথে মিলে একাকার হয়ে যাচ্ছে আমার চোখের জল। সবাইকে লুকিয়ে চোখ মুছে নেই। এই অশ্রুর দায় ভার না হয় কেবল আমারই থাক। দিনশেষের এটুকু প্রাপ্তিতেই হোক আমার পূর্ণতা। ঐ তো, সাঁইসাঁই করে এগিয়ে যাচ্ছে চার চাকার যান। সাথে এগুচ্ছে রেণুও। কেবল পিছিয়ে পড়ছি আমি। এই দূরত্ব অতিক্রম করা যে দুঃসাধ্য আমার জন্য। তবুও খুব ইচ্ছে হয়, চিৎকার করে বলি,
– এই রেণু, এই শুনছো, একটা জবাব অন্তত দিয়ে যাও। আমার সেই চিরকুটটা তুমি কী সামলে রেখেছো এখনো? তোমার সঙ্গে থাকা সোঁদা গন্ধে মাখানো ব্যাগের পকেটে, পুরোন ডায়েরীর মলিন পাতার বাহুডোরে কিংবা কোন… এই রেণু, শুনতে পাচ্ছ কী, তুমি আমার কথা এই….