বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর তিনভাগ জল আর এক ভাগ স্থল। তাই হয়ত জলের সঙ্গে মানুষের সখ্যতা সেই আদিকাল থেকেই। কালে কালে জলের এই অবারিত ধারায় অঞ্জলির মত ভেসেছে মানব জীবনের হাসি আনন্দ বিরহ বেদনা আর নানা সংগ্রাম। অকূল পাথারে নিজেকে বিজয়ী বেশে ভাসিয়ে নিতে যুগে যুগে মানুষ সওয়ার হয়েছে বিচিত্র সব জলযানে। উত্তাল স্রোতকে বিপরীতে ঠেলে দিয়ে এই স্বপ্ন ডিঙিতে চড়ে মানুষ আর সব কিছুর মাঝে খুঁজে নিতে চেয়েছে তার অপার আনন্দ রাজিকেও।
মূলত: বরফ যুগের পরেই পৃথিবীতে নৌকার আবিষ্কার হয়। বেঁচে থাকার রসদ যোগাতে কিংবা বলা যায় জীবন জীবিকার প্রয়োজনে এই জলযানের উদ্ভব ঘটে। কালক্রমে এর ব্যবহারের মাঝেও লাগে বিবর্তনের ছোঁয়া। সময়ের আবর্তে মানুষ নিজেদের কিছুটা স্বস্তি দেবার জন্য, নির্মল আনন্দ বানে ভেসে যাবার জন্য এই জলের তরঙ্গ আর এই জলযানকে বেছে নিয়েছে সাদরে। আর ঠিক এমন করেই হয়ত শুরু হয়েছিল “নৌকা বাইচ” খেলার। তবে কবে, কখন, কোথায় নৌকা বাইচের জন্ম হয়েছিল তা বলা মুশকিল। ইতিহাসবিদদের মতে, সর্বপ্রথম মেসোপটেমিয়ার (বর্তমানের ইরাক) লোকেরা এই খেলার উদ্ভাবক ছিলেন। খ্রী:পূ: প্রায় ২০০০ বছর আগে তারা ইউফ্রেটিস নদীতে এক ধরনের নৌকা বাইচ এর আয়োজন করে বলে জানা যায়। এর কয়েক শতাব্দী পর মিশরের নীল নদের জলে নৌকা বাওয়ার প্রতিযোগিতা আরাম্ভ হয়। মজার ব্যাপার, অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতাটি এখন পর্যন্ত অত্যন্ত জনপ্রিয়। এখানেই শেষ নয়, এমনকি সেই ১৯০০ সাল থেকে অলিম্পিক প্রতিযোগিতার আসরে এই নৌকা বাইচ তার স্বীয় বৈশিষ্ট্যের জন্য সগর্বে সেখানে স্থান করে নিয়েছে।
এবার আসা যাক “নৌকা বাইচ” এর নামকরণ প্রসঙ্গে কিছু কথাতে। “বাইচ” একটা ফারসি শব্দ। যার অর্থ “বাজি”। “বাজি” শব্দটি বাংলায় এসে রূপান্তিরিত হয় “বাইজ” এ যারই বিবর্তিত রূপ হল “বাইচ”। যার প্রকৃত মানে হল “খেলা”। তাহলে নৌকা রেইসে “বাজি” বলি কিংবা খেলা তাকে আমরা “নৌকা বাইচ” বলেই জানি।
আমাদের বৈচিত্রময় বাংলার উত্তাল তরঙ্গ লয়ের ছন্দে এই খেলাকে জনপ্রিয় এবং সমাদৃত করতে এর পেছনে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করেছে মুসলমান শাসকেরা। নবাব-বাদশাহী আমলে পূর্ববঙ্গের ভাঁটি অঞ্চল জয় এবং এটি রক্ষার কৌশল হিসেবে তাঁরা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নৌবাহিনীর। তাছাড়া বাংলার বারো ভুঁইয়ারা তো নৌ বলের বদৌলতেই মুঘল এবং মগদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকতেন। বারো ভূঁইয়ার অন্যতম ভূঁইয়া মূসা খাঁ এর প্রবাদতুল্য জাহাজের নাম ছিল “সুন্দল”। মাঝি মল্লাদের শক্তিতে চালিত সেই জাহাজের ভয়ে নাকি মগ আর হামার্দ জলদস্যুরা রীতিমত কাঁপত। সংগত কারণেই দ্রুত বেগে জলদস্যুদের তাড়া করবার জন্য বা যুদ্ধ শুরু করতে দরকার ছিল দ্রুতবেগের ছিপ জাতীয় নৌকা। সেসব নৌকাই পরবর্তীতে নৌকা বাইচে যুক্ত হয় বলে জানা যায়।
নৌকাবাইচ প্রকৃতপক্ষে একটি প্রাচীণ সংস্কৃতি। কি করে বাংলার সংস্কৃতির ঢেউ এ এটি মিলেছে তা আজও অজানা। এ নিয়ে অবশ্য দু ধরনের জনশ্রুতি রয়েছে। জগন্নাথ দেবের স্নান যাত্রাকে কেন্দ্র করে এর উৎপত্তি বলে দাবী করেন অনেকে। এই স্নান যাত্রায় যোগ দেবার জন্য মাঝি মাল্লারা প্রতিযোগিতায় নামত এই প্রমাণ করতে যে কে কার আগে যেতে পারে। এভাবেই হয়ত নৌকা বাইচের উৎপত্তি।
পক্ষান্তরে শোনা যায়, ১৮ শতকে কোন এক গাজী পীর মেঘনা নদীর এক পাড়ে দাঁড়িয়ে অপর পাড়ে থাকা ভক্তদের কাছে ডাকেন। সেই সময়ে ঘাটে কোন নৌকা ছিল না। ভক্তরা তাঁর কাছে আসার জন্য ১ টি ডিঙি নৌকা খুঁজে বের করেন। সেই নৌকাটি মাঝ নদীতে গিয়ে ঝড়ের কবলে পড়ে। তখন চারপাশের যত নৌকা ছিল তারা খবর পেয়ে ছুটে আসে। সারি সারি কলাপাতার মত নৌকা সব পাল্লা দিয়ে ছুটতে থাকে। এটা থেকেই নৌকা বাইচ এর সূচনা হয়। তবে সূচনা যাই হোক না কেন, নদী মাতৃক এই দেশে এই খেলাটি জনপ্রিয় হতে বেশি বেগ পেতে হয় নি। কারণ, নদী নির্ভর এই দেশের বরাবরই অতি জনপ্রিয় বাহন নৌকা। আর এই নৌ শিল্পকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শিল্পকেন্দ্র। এসব শিল্পে যুগ যুগ ধরে তৈরী হয় দক্ষ ও অভিজ্ঞ কারিগর। আর এমন করেই বিভিন্ন নৌ যানের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা ভিত্তিক খেলার গোড়াপত্তন ঘটে থাকে। বাংলাদেশে নৌকা বাইচের উপযুক্ত সময় ধরা হয় ভাদ্র ও আশ্বিন মাসকে। এই সময় সব বহতা স্রোতস্বীনী সব পানিতে টই টুম্বুর হয়ে থাকে বিধায় বাইচ প্রতিযোগিতার জন্য বছরের এই সময়টি বেছে নেওয়া হয়।
এখন জানা যাক, বাইচে ব্যবহৃত নৌকা সম্পর্কে। ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে চলা এই নৌকাগুলো মূলত সরু ও লম্বাটে হয় যাতে করে এই নৌকাগুলো পানি কেটে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারে। বাইচের নৌকাগুলোর নামও হয় বিচিত্র রকমের। সোনার তরী, অগ্রদূত, ঝড়ের পাখি, পঙ্খিরাজ, ময়ূরপঙ্খী, দ্বীপরাজ এমন আরও অনেক বাহারি নামে পরিচিত হয় ওরা। নৌকাগুলোকে দৃষ্টিগোচর ও দৃষ্টিনন্দন করে তুলতে ওদের গাত্র রাঙিয়ে নেওয়া হয় বর্ণিল রঙে। আর এদের সম্মুখভাগ অলংকৃত করা হয় ময়ূর, রাজহাঁস, বা অন্য কোন পাখির মুখের আদলে। নৌকায় উঠবার জন্য রয়েছে বিশেকের আনুষ্ঠানিকতা। সকলে পাক পবিত্র হয়ে গেন্জি গায়ে মাথায় একই রঙা রুমাল বেঁধে নেয় জোরসে। এদের সবার মাঝে থাকে নির্দেশক। নৌকা চালিয়ে নেয় পেছনে থাকা মাঝিরা। প্রতি নৌকাতে সাত, পঁচিশ, পঞ্চাশ বা ক্ষেত্র বিশেষে একশত জন মাঝিও থাকতে পারে যারা নৌকার দুপাশে বৈঠা হাতে সারিবদ্ধ ভাবে বসে থাকে। বৈঠা টানাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করবার জন্য একজন গায়েন থাকেন যে কিনা নৌকার গুলুইয়ে আসন গ্রহণ করেন। এই সময়ে মাল্লারা একত্রে যে গান গায় তাকে সারি গান বলে। নৌকার মাঝে গায়েনদের ঢোল তবলা ও করতালের সঙ্গে সঙ্গে এই মাল্লাদের এক সুরে সংগীত যজ্ঞের মধ্য দিয়ে নৌকা তার অভীষ্ট লক্ষ্যে ছুটে চলে। এই সংগীতেরও কিন্তু বিশেষত্ব রয়েছে। কখনও এর সুরে কোন ইতিহাস কথা বয়ান হয়ে যায় কখনও বা আধ্যাত্মিক কোন আখ্যানের ইতিবৃত্ত জানা হয়ে যায়। আর এই সারি গানের তালের ঝোঁকে ঝোঁকে নৌকার বৈঠাও এক হিসেব মেপে চলে। মজার ব্যাপার এই তাল লয়ের চমৎকার যুগলবন্দী ছন্দের কারণে মূলত কারও বৈঠার সাথে কারও বৈঠার ঠুকাঠুকি লাগে না বরং এই মূর্ছনা পানিতে এক দারুণ অভিঘাতের সৃষ্টি করে। গায়েন কাঁসির শব্দে এই বৈঠার এবং গানের গতিকে সাবলীল রাখতে সাহায্য করে। প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাবার জন্য প্রয়োজন বোধে কাঁসির শব্দে বৈঠার গতি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয় এবং সেই সাথে গানের গতিও বেড়ে চলে। এই সময় মেজাজ চাঙা রাখতে “হৈ হৈয়া” এ ধরনের শব্দের ব্যবহার দেখা যায়।
আল্লায় বলিয়া নাও খোল রে
ভাই সক্কলি
আল্লাহ বলিয়া খোল।।
ওরে আল্লা বল নাও নাও খোল
শয়তান যাবে দূরে
ওরে যে কলমা পইড়া গেছে
মোহাম্মদ রাসূলরে
ভাই সক্কলে..।।
মল্লাদের কন্ঠে যখন এমন দরাজ সুর ভেসে আসে তখন বিশাল নদীবক্ষে যেন উন্মাদনার জোয়ার জাগে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে ফরিদপুরে বয়ে যাওয়া বিভিন্ন নদীর কোল ঘেঁসে নৌকা বাইচের আয়োজন করা হয়। কাঁসা, ঢোলের ধাতব ঝংকারের সাথে বৈঠার সলাৎ সলাৎ শব্দে মুখরিত হয় নদী অববাহিকা। গ্রামের উৎসাহ নিয়ে নানা ধরনের নৌকা সাজিয়ে মাইক বেঁধে অবস্থান নেয় নদীর দু পাড়ে। দর্শনার্থীদের অংশগ্রহণে চরম উপভোগ্য হয়ে ওঠে নৌকা বাইচ। বাইচকে কেন্দ্র করে দুই পাড়ে মেলা বসে। মিষ্টি, খেলনা, মোয়া মুড়কি, রঙের আবিরে জমে ওঠে অনবদ্য এক মিলন মেলা।
তবে আফসোস, নদী নালার ভরাট হয়ে যাওয়া, লোকজনের উদাসীনতা, দেশীয় সংস্কৃতির ওপর অনাগ্রহ ও একে লালনের অভাব, আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনের করাল গ্রাসে এই ঐতিহ্যবাহী খেলাটির অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। তবে আশার কথা, বর্তমানে এই বিলুপ্ত প্রায় খেলাটিকে বাঁচিয়ে তুলতে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ বোয়িং ফেডারেশন কতৃক গৃহীত ব্যবস্থা সমূহ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হলেও প্রশংসার দাবীদার।
পরিশেষে বলতে হয়, নদী ক্রোড়ে আশ্রিত শ্যামল বাংলাদেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির এক মূল্যবান অলংকার হলো এই নৌকা বাইচ। এর সুললিত ছন্দে জেগে ওঠে বাংলার কৃষ্টি ও সংস্কৃতির কোরাস। যার তাল লয় লালন করে রাখে আমাদের আবহমান বাংলার অস্তিত্বকে। ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে বাঙাল অস্তিত্বকে জীবিত রাখতে ঐতিহ্যবাহী এই বাইচের দাঁড় সগৌরবে বেয়ে চলা বর্তমান সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ দাবী।
তথ্যসূত্র: পত্রপত্রিকা, জার্নাল, ইন্টারনেট