সোনিয়া তাসনিম খান
জীবন দিনলিপির শ্বেত পত্রগুলো কৃষ্ণ কালির আঁচড়ে ভরে উঠছে অলক্ষ্যে। চড়ুই পাখির চঞ্চল ডানাতে ভর করে ফুড়ুৎ করে শৈশব পেরিয়ে কৈশোর… এরপর কখন যে যৌবনের নীল আকাশে এসে পড়লাম! আজ অবধি তার রহস্য কুয়াশার মতো আবছাই রয়ে গেল।
ভুবনডাঙার সময়ের তরঙ্গ সাঁতরে তরতরিয়ে এগিয়ে চলছে জীবন তরী। এককালের কাজল কালো কেশে ধীরে জেগে উঠছে শুভ্রতার আলপনা। আমার উপরের খোলস ক্রমশ হয়ে উঠছে পরিণত। কিন্তু কখনও কখনও মনে হয় মহাকাল বুঝি থেমে রয়েছে সেই আগের জায়গাটিতেই। যেন এখনও কিচ্ছুটি বদলায়নি। না আমি, না অন্য কোনও কিছু।
হ্যাঁ, তাই তো! ওই তো দেখা যাচ্ছে একহারা গড়নের দ্বিতল বাড়িটা। মরচে পড়া গেটের বাইরে বসে ঝিমোচ্ছে দারোয়ান। কিচিরমিচির শব্দ তুলে সর্পিল রাস্তার উপর ধুলো উড়িয়ে ছুটছে অটোরিকশা। ওদের গায়ে রং তুলির প্রলেপে বাংলা সিনেমার পোস্টার সেঁটে দিয়েছে কোনও নাম না জানা অখ্যাত পটুয়া। হাড় জিরজিরে টোকাইয়ের দল সামনের বিল্ডিংটার গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকা বড়ই গাছে ঢিল ছুড়তে ব্যস্ত। অলস পদক্ষেপে রাস্তা মাড়িয়ে চলছে এক হুলো।
দূরে এক মুঠো রঙিন স্বপ্ন হাতে নিয়ে একজন বেলুনওয়ালা বেলুনে কচকচ ছন্দ তুলছে। ওর সঙ্গে থাকা বাঁশের মাচাটাতে বর্ণিল কাগজে তৈরি মৌচাকগুলো মৃদু বাতাসে দুলছে অল্প অল্প। দু’হাতে বারান্দার গরাদ পাকড়ে তাতে মুখ গুঁজে আমি দেখে যাই ওদের। নীল আকাশের গায়ে দু’-একটা চিল উড়ে বেড়ায়। কাপড় শুকোনোর রশিতে বসে দোল খাচ্ছে এক শালিক। ঘাড় বেঁকিয়ে এদিক ওদিক কিছু দেখে নিল বুঝি। তারপরেই ফুড়ৎ।
জায়গাটিতে কেবল শূন্যতা এখন। বুকের মাঝে কেমন এক হাহাকার জেগে উঠে। মাটিতে বিছিয়ে নেওয়া মাদুরের উপর হাট করে খুলে রাখা বাংলা বই। পাশেই বাংলা খাতা। নতুন একদম। সকালেই বাবা কিনে দিয়েছে। হালকা সবুজ রঙের উপর একজন বয়োজ্যেষ্ঠ কেমন মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। এনাকে আমি খুব চিনি। বসার ঘরে যে বইয়ের তাকটা রয়েছে, সেখানে সাজিয়ে রাখা বইয়ের মলাটে এনার ছবি ছাপা রয়েছে। কিন্তু সে আবার আমার খাতার মাঝে এল কী করে? আমি আবারও ছবিটা দেখে যাই। কী সুন্দর ওঁর চোখ দুটো! যেন উপরে ঝুলে থাকা ওই বিশাল অন্তরীক্ষ তার নয়নযুগলে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে। কোঁকড়ানো সাদা চুলগুলো দু’পাট করে আঁচড়ানো, সাগরের ঢেউয়ের মতো ওরা আছড়ে পড়েছে চওড়া কাঁধের উপর। জানি না কেন, আমি আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকি ওঁর দিকে। কেমন বিচিত্র এক মোহ জেগে ওঠে মনে। আচমকা বুঝি ওই ওষ্ঠদ্বয়ে টলটলে জলবিন্দুর মতো হাসির ঝিলিক জেগে ওঠে। বাতাসে যেন ভেসে আসে ফিসফাস—
—এই যে খোকা, যাবে আমার সাথে?
কোন কথা বের হয় না মুখ দিয়ে। কেবল মাথা নেড়ে শুধোই
—কোথায়?
উত্তর মেলে না কোনও। তবে অনুভূত হল, বুঝি আমি ছুটছি এক রাঙা ঘোড়ার পিঠে চেপে। আমার চারপাশে মাথা দোলাচ্ছে সবুজের ঢেউ। মাটির গন্ধ উড়ছে বাতাসে। আমি ছুটছি তো ছুটছি। ঘোড়ার ক্ষুরে ধুলো উড়িয়ে অকাতরে পার করে নিচ্ছি চোরাকাঁটাতে ঢাকা জোড়াদিঘির মাঠ! মরা নদীর সোঁতা। কিন্তু একি! আমার সঙ্গে এই পালকি এল কী করে? কে রয়েছে ওতে? আমি উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করি। চোখে আমার পড়িয়ে নেওয়া কৌতূহলের মায়া কাজল। বেয়ারাদের কাঁধে চেপে পালকি ওঠানামা করছে থরথর। ধীরে সন্ধ্যে নেমে আসছে পটে। রাক্ষুসে এক আঁধারের বলয় যেন গ্রাস করে নিয়ে যেতে চাইছে সব কিছু।
কেমন ভয় জাগে চিত্তে। আচমকা ‘হারে রে রে রে রে’ রবে শোরগোল শোনা যায় কোনও অজানা প্রান্ত থেকে। বেহারাদের দল ভয়ে গুটিয়ে পড়ে। ভীরু খরগোশের মতো ওরা কাঁপতে থাকে বুঝি। বর্গী এল কি তবে? তলোয়ারের বাট সজোরে পাকড়ে নেই আমি। আচমকা কেমন করে আজও পালকির দু’পাল্লা কিঞ্চিৎ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে সামনে। বিস্ময়ে থমকে যাই। মা আমার পালকিতে যে বসে! পদ্মের মতো কোমল বদনখানি কেমন বিবর্ণ দেখাচ্ছে। কিন্তু কেন? মা কি আমার ঘাবড়ে গিয়েছে তবে? ভয় কী মা, সঙ্গে রইল তোমার বীরপুরুষ এই ছেলে? আমার সামনেই আমি আবারও মুচকি হেসে বলি—
“আমি আছি ভয় কেন মা কর?”
মা বলে যায়, “যাসনে খোকা ওরে…”
আমি আবার বলি, “দেখ না চুপ করে…”
আর, ওই তো! আজ এতকাল পরে আবারও সেই ঝাঁকড়া চুল ও কানে জবার ফুল গোঁজা বর্গীর দলের দেখা মিলে গেল। বহু কাল আগের সেই কল্পচিত্র আজ আবার দৃষ্টিসম্মুখে নদীর চরের মতো জেগে উঠল যেন। সেদিনের মতো আজও আমি আবার মুখ তুলে নেই উপরে। আশ্চর্য! বিস্তৃত সেই গগন যেন আজও একই ভাবে ভেসে যাচ্ছে সেই মায়া দৃষ্টির স্রোতে। মেঘের পর মেঘের স্তর জমে যেন ফুটে উঠেছে সেই মুখ। তাতে মাখানো সেই স্মিত, শান্ত হাসি। আবার বুঝি অনিল নাওয়ে ভেসে আসে ফিসফাস
— ভয় কি, খোকা? বলো।
বাতাসের গান পাকড়ে নিই আমি। মুচকি হেসে ফের বলি—
“দাঁড়া খবরদার
এক পা আগে আসিস যদি আর
এই চেয়ে দেখ আমার তলোয়ার
টুকরো করে দেব তোদের সেরে…”
লেখাটি কোলকাতা থেকে প্রকাশিত সাদাকালো অনলাইনে প্রকাশিত: লিঙ্ক