২০০৯ সাল। মার্চ মাসের কোন এক সময়। সিংগাপুর এ এম .আর টি স্টেশান এ দাঁড়িয়ে আছি। উদ্দেশ্য, সিংগাপুর পলি টেকনিকে যাব। এক্সপোর্ট ইমপোর্ট বিজনেসের ওপর একটা কোর্স এ্যাটেন্ড করব। অপেক্ষা করছি বাসের জন্য। তখন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল বাইরে। পলিতে আমার বেটার হাফ এর তখন লাঞ্চ ব্রেক চলছে। এক সাথে মজা করে ম্যাকডোনাল্ডের “বিগ ম্যাক” খাব সেটাও প্ল্যান এ ছিল। রাস্তা দিয়ে অনেক প্রেগন্যান্ট মহিলা হাঁটাহাঁটি করছিল। বেশির ভাগেরই চিত্রটা এরকম। বেবী ক্যারিং ব্যাগে একটা, পাশে হাত ধরা একটা, এবং ডাবল প্র্যামের সীটে দুটো। এই ট্যাবলেট প্রতিটার মুখে একটা করে চুসনী গোজা ।বেচারা গুলো ল্যাতপ্যাত ঘাড়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে থাকে। ভাবি, এখানকার আবহাওয়া কি কনসিভ করার জন্য উর্বর বেশি? নাকি এখানকার মানুষেরই শখ বেশি? তখনও মা হইনি তাই বাচ্চা কাচ্চার মামলাতে আগ্রহ আর ভীতি দুটোই বলবৎ ছিল বৈকি!
যাক, বাস এসে যাওয়াতে উঠে পড়লাম নেমে গেলাম সিংগাপুর পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের সামনে। গেটের সামনেই মহাশয়ের দেখা পেলাম । রেজিস্টার অফিসে পাসপোর্ট কপি আর পেমেন্ট ক্লিয়ার করলাম। ক্লাস এক সপ্তাহ বাদে চালু হবে। এরপর বিগ ম্যাক গিলে বাসার উদ্দেশ্য রওয়ানা হলাম। ও থেকে গেল পলিতে।ওর ক্লাস ছিল।
আমরা তখন সিংগাপুর গিয়েছিলাম ওর ক্লাস ওয়ান কম্পিটেন্সি টেস্টের জন্য। আমাদের বাসা ছিল ক্লেমেনটি এভিনিউ ২ এ। এ কলোনীতে বেশিরভাগ বাঙ্গালী পরিবার থাকে।বাস থেকে নেমে বাসায় আসার পথে ফের হতচ্ছাড়া বৃষ্টি। ভালোই কাকভেজা হলাম। ঘরে এসে বেশ মুডের সাথে কাপড় চেঞ্জ করে রাইস কুকারে খিচুড়ি বসালাম। কড়াইয়ের তেলে ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ তুলে ভেজে নিলাম ডিম আর বেগুন। উম! আজকে ডিনার হবে সেরকম। তারপর রিল্যাক্স মুডে ভেজা কাপড় গুলো চালান দিলাম ওয়াশিং মেশিনে। যত্ন করে বেষ্ট ডিটারজেন্ট পাউডার তাতে চামচ দুয়েক ঢেলে দিলাম। ঢাকনা নামিয়ে প্রেস করে দিলাম স্টার্ট বাটন। ব্যাস! হয়ে গেল! ভেতরে থাকা কাপড়গুলো অ্যাংগেল বদলিয়ে বদলিয়ে ঘুরছে। আহা! তখনও তো বুঝিনি আমার কাপড় শুধু না, তার সাথে আরও কী কী ওয়াশ হয়ে যাচ্ছে!
সন্ধ্যে বেলায় মেশিন বিপ করা শুরু করল। ধোলাই খতম হয়েছে। ভাবলাম, একবারে রাতে খাওয়ার পর কাপড়গুলো মেলে দিব। খাওয়া শেষে ওয়াশিং মেশিন এর টপ ওপেন করে দেখি ধোয়া কাপড়ের ওপর গুড়িগুড়ি অসংখ্য কাগজ। এগুলো এলো কোত্থেকে? একটা টুকরা হাতে নিয়ে খেয়াল করলাম তাতে লেখা “রিপাবলিক অফ সিংগাপুর”। সর্বনাশ! এতো ভিসার সীলমোহর! ঝট করে মনে হলো আসার পরে প্যান্টের পকেট থেকে তো পাসপোর্ট বের করা হয়নি। তার মানে শুধু কাপড় না! মেশিন বাবাজি আমার পাসপোর্টেরও ধোলাই করে দিয়েছে। মেরুদন্ড দিয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে গেল। আচ্ছা,এসব দেশের শ্রীঘর গুলো দেখতে কেমন হয়? কুল কুল করে ঘামতে লাগলাম। এখন উপায়? ভীত ভাবে রুমে গেলাম। পতিদেব গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করছে। চিকন সাপের মত ওকে পাশ কাটিয়ে বিছানা যেয়ে বসি
“কী ব্যাপার? আমার বউ কী করে?” গদগদ গলায় ও জিজ্ঞেস করে
– শোন না, একটা না ঘটনা ঘটেছে।
– কী হয়েছে, টিয়া পাখি?
– পাসপোর্ট ওয়াশিং মেশিনে ধোয়া হয়ে গেছে।
এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলি কথাটা। কথাটা বুঝতে ওর বুঝি কিছু সময় লাগল। আর সেই সাথে ওর চেহারাটা তখন ছিল দেখার মত। মনে হলো ও ৪৪০ ভোল্টের শক খেল। মুখের হা টা বড় হতে হতে সরু হয়ে গেল। চোখদুটো ছোট ছোট হতে লাগল। ঝড়ের পূর্বাভাস পেলাম যেন। গুটিশুটি মেরে বসি। হাতের পাঁচ আঙ্গুল আপনা আপনি মুখে চলে গেল।
পরমুহুর্তে বজ্রপাতের আওয়াজ পাই।
– আর ইউ ক্রেজি? কী করেছ কী তুমি এটা? ধ্যান থাকে কই তোমার?
কথাগুলো সব মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছিল। এখন ওর হাতের উত্তম মধ্যম খেলেও বোধ করি বাড়াবাড়ি বলে কিছু হতো না। কিসের খিচুড়ি, কিসের কী বকার তুবড়ি বান এ পেট আমার ভর্তি হয়ে গেল। উফ! কত প্ল্যান করেছিলাম আজকের জন্য গেল সব ভেস্তে গেল। এখন উপায়? রাতে শুয়ে শুয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছিলাম আর ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছিলাম, বিশাল ভুলভুলাইয়াতে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। যে রাস্তা দিয়ে যাই শেষ মাথায় কালো পোশাকের সিংগাপুরী পুলিশ দেখতে পাই। পিছনে ফিরি তো দেখি বিশাল দেহী লোমশ মাকড়সা পথ আগলে দাড়িয়ে আছে। মুখটা হাসিহাসি । মাকড়সাও হাসে নাকি? আশ্চর্য!
সিংগাপুর এ্যাম্বেসীর লিকলিকে ডিউটি অফিসার আমার মাস্টারপিস পাসপোর্ট উল্টে পাল্টে বলল
– ইট’স টুও ওয়েট টু রিপ্রিন্ট দ্য ভিসা। বেটার, ইউ গাইস গো টু বাংলাদেশ এ্যাম্বেসী এন্ড রিনিউ ইওর পাসপোর্ট ফার্স্ট।
আমার জামাই আমার দিকে যে চাহনিতে তাকাল মনে হলো ওখানেই বুঝি আমার চামড়া কেটে ঢোল বানিয়ে আমারই হাড্ডি দিয়ে বাজানো শুরু করবে। মুখে একটা খরখরা হাসি ধরে রাখলাম কোনমতে। তো, আর কী করা? গেলাম সেখানে। বাংলাদেশ অ্যাম্বেসী তে। ঐখানকার একজন অফিসার পাসপোর্ট দেখে জিজ্ঞাসা করল
-কিভাবে এটার এই দশা হলো?
“বৃষ্টিতে ভিজে।” আমার কর্তা উত্তর দিল আমিও সাথে পোষা তোতার মত সায় দিলাম।
“বৃষ্টি!” অফিসারের ভ্রূ কুঁচকে গেল।
– এত বৃষ্টি কখন হলো? দেখে তো মনে হয় বালতিতে ধোলাই করেছেন।
অগত্যা সত্য বলতে হলো আর গোটা রুমে তখন হি হি হা হা হো হো শুরু হলো।
যথারীতি বকা খেতে খেতে বাসায় আসলাম। এ কতদিন যে কত বকা খেলাম তার ইয়াত্তা নেই। মনে হয়, এই বকার হিসেব গিনিস বুকের এরা খোঁজ পেলে নির্ঘাত আমার নাম টুকে রাখত নিশ্চিত। বাসায় এসে মনমরা হয়ে আছি। ও এসে কাঁধে হাত রেখে বলল, “চিন্তা করো না দেখি কী করা যায়।”
পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার পাসপোর্ট জানালার কার্ণিশে শুকাতে দেয়া আর ও বসে বসে ওটা পাহারা দিচ্ছে যাতে পাখিরা ওটা তে “ইয়ে” করে না দেয়। তিনদিন ধরে দুজন এটাকে সানবাথ করালাম। এরপর মেঝেতে কাপড় বিছিয়ে তার ওপর এটাকে রেখে আবার তার ওপর কাপড় দিয়ে দিলাম ইস্ত্রী দিয়ে ডলা। এত পরিশ্রমের ফলে এটা মোটামুটি কোমা ফেরত রোগীর অবস্থায় এলো।
এখানে অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ দিতে হয় পাসপোর্টের কাগজ গুলো সত্যি অনেক ভালো মানের। আমার নাম ধাম চৌদ্দ গুষ্টি সব ঠিক ছিল শুধু ভিসা গুলোর প্রিন্ট উঠে গিয়েছিল। আহারে! আমার সাধের সেনজান ভিসাটা, তার তো কোন নাম নিশানাই ছিল না।
যাই হোক, দোয়া দরুদ পরতে পরতে আবারও সিংগাপুর এ্যাম্বেসী গেলাম এবং এবার ওরা আমার পাসপোর্ট রিসিভ করল ভিসা রিপ্রিন্ট দেয়ার জন্য। এক সপ্তাহ পর নির্ধারিত তারিখে পাসপোর্ট কালেক্ট করলাম। খর খরা মচমচা টোস্ট বিস্কিট টাইপ পাসপোর্ট তার মাঝে আমার নতুন চকচকে মাল্টিপেল ভিসা। হাতে নিয়ে আত্মায় পানি আসল। যাক, বাবা এ যাত্রায় বাঁচালাম তাহলে!
: কি, চিন্তা গেল? একটু স্টেডি হও তো এবার। কাছে আসত, একটু আদর করি। এই কদিন অনেক বকা দিয়েছি। আমার বউটা যে এত অস্থির!
আমার বরের এবার মেজাজ নেমেছে। ও বলতে থাকে
: বলি, এবার চল, মা বাবা হিসেবে প্রমোশন নেই। তাতে যদি আমার পাগলী বউটা একটু স্থির হয় আর কী।
ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। দিলই না হয় একটু বকা। তাতে কী? এই বকাগুলোই তো সাহস দিয়েছে আমাকে। আরও শক্ত করে ধরি দুজন দুজনকে। আর এতদিন পর প্রাণ খুলে হাসতে থাকি আমরা।