আমি তোমাকে চিনি

by soniatasnim
আমি তোমাকে চিনি। সেই তখন থেকে। হ্যাঁ। কখনও দেখা হয় নি আমাদের, সত্যি! কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার পরিচয়, সে তো বহু দিনের! সেই যে চৈত্র দিনের অলস বেলা, মনে পড়ে? ঝরা পাতার মর্মর ছন্দের আগে দিনান্তের নরম আলো ওর সোনালী আঁচল যখন বিছিয়ে দিত কন্টক ফুলের ওপর। সাদা সাদা ফুলগুলো তখন ঠিক যেন মনে হত, আসমানের নীল জমিনে ফুটে থাকা হীরক তারা। ক্লান্ত বিহঙ্গের মখমল পাখায় কেমন ভর করে ধীরে নেমে আসত সন্ধ্যা রাণীর রাগ। আবির রঙে রাঙানো বিকেলে যখন বাতাস ভারী হয়ে উঠত নওল কিশোরদের কলতানে! পাড়ার ইস্কুল বারান্দায় ঝুমকো লতার ন্যায় দুলতে থাকা সূর্যের মত প্রকান্ড গোলাকার ধাতব ঘন্টাটা তখন বিশ্রাম পোহাত বেশ! প্রবীর দাদুর কুঁচকে যাওয়া মুখের চামড়ায় পরম শান্তিতে মুখ লুকিয়ে নিত সব ক্লান্তি নুড়ি! নীল গগনে কৌতুহলী বালিকার ন্যায় সাঁতরে বেড়াত মেঘ কুমারীর দল! আমার বাতায়নের চিবুক ছুঁয়ে দিত সলজ্জ মাধবী লতার নুয়ে পড়া ডাল। কখনো হাত বাড়িয়ে ওদের ছুঁয়ে দিতাম, কখনো দিতাম না। গেঁয়ো যোগীর মত সামনের ছুটে চলা পথে মল পায়ে দৌড়ে যেত রৌদ্র কিশোরী।
রোজ নিজের ঘরের দোহারা জানালায় বসে দেখে যেতাম সেসব দৃশ্য। একই ছবি, একই গল্প তবুও রোজ যেন নতুন কোন আবেশে এসে ধরা দিত অকপটে। দিন শেষের ঐ লাজে মূর্ছে যাওয়া রঙিন ফুলের ওপর বসে পড়া, ঐ যে প্রজাপতি, ওর বর্ণিল ডানা কেমন ধীর লয়ে মেলে ধরত, আর ওর বিস্তৃত পাখার পরে যেন আমার সব স্বপ্ন রেণু মিলে মিশে একাকার হয়ে যেত। আমি মুগ্ধ নয়নে কেবল দেখে যেতাম। তবে, এই জিজ্ঞেসা বুঝি ঐ দুষ্টু কাঠবেড়ালীর পেয়ারা খাবার হর্ষ থেকে ভিন্ন ছিল। কেমন অদ্ভুত! চিরচেনা সব কিছুতেই কেমন যেন অন্য স্বাদ খুঁজে নিতে মত্ত হয়ে পড়তাম যখন তখন। কালের আবর্তে কি তবে মনের আবেদন এভাবেই বদলে যায়? ভরা যৌবনা যুবতীর মত টলটলে কাক চক্ষু নীরদে টইটুম্বুর পুকুর পাড় ঘেঁষে বাউন্ডুলে যুবক প্রতিম ঠাঁয় হয়ে থাকা যে লিচু গাছটা, ওটার পাতার ফাঁকে খেলে যাওয়া এক কালের পবন ভেলায় ভেসে চলা সময় পেড়িয়ে নিয়ে আমার জীবন দুয়ারে তখন উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে যৌবন দূত। কচি হাতের মুঠো কেমন লিচুর থোকার বদলে সেই সময় তুলে নিয়েছে ভাবনার তুলি। আমি ব্যস্ত তখন আমার অসম্পূর্ণ প্রতিলিপি সম্পূর্ণ করবার দুর্বার তাগিদে। হাতে তখন ধরা থাকত সেই যে বইটা! বেগুনি রঙা মলাট, যেন অস্তগামী রবি কিরণের এক ঝলক সেখানে নিজেকে ছলকে নিয়েছে খুব। তাতে কৃষ্ণ কালিতে এঁকে নেওয়া তোমার অবয়ব। কি করে বুঝাই বল! ও যে কেবল আঁকিবুঁকি ছিল না , ওটা যে ছিল আমার অনুরাগের প্রেরণা, আমার ….সে যাক গে! ওকথা বরং তোলাই থাক! কেবল একথা জেনে নাও, কোন এক অজানা মোহে আমি তখন আলতো হাতে ছুঁয়ে দিতাম কলমে খোদাই করে নেওয়া তোমার সেই উন্নীত নাক, প্রেমাবেগে উজ্জ্বল নয়ন যুগল আর দৃঢ়তায় ভরা মুখখানি। অস্থির অঙ্গুলি আমার হঠাৎই থমকে যেত তোমার ওষ্ঠ্য ছুঁয়ে থাকা সেই মোহনীয় বাঁশির আগে। মনে জেগে উঠত আষাঢ়ে নাদের মত কৌতুহল! আচ্ছা? কি রাগ তুলতে তুমি তোমার মুরালিতে? বড্ড জানতে ইচ্ছে হত। তবে সেটা আর জানা হয়ে উঠে নাই। নশ্বর এই জগতে সব জানা কার সাধ্যি বল? দু মলাটের মাঝে সেঁটে থাকা তেত্রিশটা পাতা। ওতে কালো অক্ষরের ঠাঁস বুনটে লেখা কত কত ছন্দমালা! অক্ষরগুলো যেন একদম আম্র গাছের মোটা কান্ড বেয়ে চলা কৃষ্ণ পিপীলিকীর দল! আমি তৃষ্ণার্তের মত ওতে আঁছড়ে পড়তাম। সে যে কি নিগূঢ় রহস্য! পংক্তির ঢেউ তো নয়, যেন এক অসীম সাগর, আর সেই সাগরের বুকে সব সুরের গভীর তরঙ্গ মালা! আমি অনায়সে ডুবে যেতুম সেই সুরের অতলায়ন্ত গভীরে! নিজেকে ভাসিয়ে নেবার কোন অভিপ্রায় জাগত না চিত্তে। সুরের মূর্ছনার আগে যেন আত্মাহুতির সংকল্পে বেঁধে নিতুম নিজেকে। বলতে পার, ঠিক যেন জ্বলন্ত অগ্নিশিখার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া পতঙ্গ কোন! নিজেকে হারায়ে খুঁজবার তাগিদে মাঝে মাঝে দৃষ্টি চলে যেত ঐ দূর নীলিমায়! জানালার গরাদ ছাপিয়ে বালক অনীল ঝাঁপিয়ে পড়ত আমার রিক্ত কোলে। আমি অপলক হয়ে দেখে যেতাম কেবল। গগনের বিশাল আঙ্গিনায় একে একে জড়ো হত মেঘ মালার স্তুপ! স্তব্ধ আমি রুদ্ধশ্বাসে অবলোকন করতাম সেই মায়া আখ্যান। ধীরে অন্তরীক্ষের মায়া কাঁচে ফুটে উঠত সেই রূপ! যাকে আমি দিবানিশি সন্ধান করে যেতাম কেবল। কল্পনার আবছা সুরমা কালিতে আমি এঁকে নিতাম এক মুখ! খুব করে ভালবাসতে চাইতাম সেই সদ্য হয়ে ওঠা কোন অদেখা, অজানা যুবতীকে। জোর বাতাস বয়ে যেত আচমকা! উঠোনের নয়নতারার ঝোঁপে খেলে যেত এক অজানা আলোড়ন! টুপটাপ কটি নয়নতারা ঝরে পড়ত হেথায়! যেন প্রণয় দেবীর অর্ঘ্যের ডালি পূর্ন করে দেবার আকুতি থাকত ওসবে জড়িয়ে। কল্পনায় কতবার আমি আলতো হাতে ওদের কুড়িয়ে নিয়ে খুব যত্নে বসিয়ে দিয়েছি সেই কুন্তল খোঁপায়! যার সুডৌল বুনন বেষ্ঠনীর ডোরে আমার হৃদয়ের স্পন্দন গেঁথে যেত অবলীলায়! জলরঙে ধুয়ে নেওয়া আসমানের আরশিতে তখন পুরোদমে স্পষ্ট হয়ে উঠত সেই আদল। মেঘেরা যেন ওকে স্পর্শ করে নিত পরম যত্নে। দূরের নীল তারাকারাজি কেমন নিলজ্জের মতন মুখ ডুবিয়ে নিত সেখানে! আমি চাতকের মত আমার প্রথম প্রেমের অস্তিত্বকে যেন ছুঁয়ে নিতাম আনমনে। অজান্তেই বিড়বিড়িয়ে যেতাম সেই আপন আবেগী সুর -“মোর প্রিয়া হবে এস রাণী…দেব খোঁপায় তারার ফুল…”
হ্যাঁ। জান তো? এমন করেই, তোমার কথাকলিতেই যে পূর্ণতা পেয়েছিল আমার প্রথম ভালো লাগার আখ্যান। এভাবেই তোমার সুরের ডানাতে চেপে প্রথম ভালোবাসার আবেশে ভিজতে শিখেছিল আমার আবেগী মন! কখনও আধো রাতের শশাংক হয়ে আলো বিলিয়ে, কখনো শাওন রাতের অবারিত ধারার পরে স্মৃতির বর্ষা হয়ে, তো কখনও হংস মিথুনের বেশে অবাধে সাঁতরে নিয়েছি অনুরাগের শান্ত দিঘীর জল, তো কখনও চরে বেড়িয়েছি অনুভূতি নদীর বালু চরে। হৃদয়ের কথাগুলো যে প্রথম পড়তে শিখেছিলাম এভাবেই। সেই পড়ে নেবার সাধ যে আজও মেটে নি আমার! তোমার কথাতেই যে, সরব হতে শিখেছিল আমার হৃদয়ের যত নীরব আকুতি; যার স্রোতের কলতান আজও বয়ে চলেছে একই তালে, একই লয়ে। আমার শত জনমের প্রেমের অঞ্জলি এখনও যে একাত্ম হয়ে বয়ে যায় আমার আঁখি জলের গাঁথা মালায়। জান কি? আজও আমি সেইদিনের মতই অপেক্ষায় রয়েছি, সেই চাওয়ার পালার অবসান লগ্নের খেয়ালে… জানি নে, এই অপেক্ষার প্রহরের কোন শেষ হবে কি কোনদিনও? প্রিয়ার খোঁপার বাহুবন্ধনীতে হৃদয়ের যে সুর ফেঁসে গেছে বহু আগেই তা থেকে তার মুক্তি মিলবে কি আদৌ? আমার পিয়াসী মনের আকুতি পৌঁছুবে কি তার কাছে? কি জানি?
হ্যাঁ। আমি তোমাকে চিনি! সেই তখন থেকে! যখন থেকে এই হৃদয় কাউকে চিনতে শিখেছে। হ্যাঁ! আমাদের কখনো দেখা হয় নি, সত্যি! কিন্তু তোমার সাথে আমার পরিচয়, সে তো বহুদিনের-ই পুরোন এক গল্প!

Related Posts

Leave a Comment