যদি প্রশ্ন করা হয়, সৌন্দর্য রাণী চট্টলা সুন্দরীর প্রেমে কেউ মজেছেন কিনা? তাহলে উত্তর যে হ্যাঁ-ই মিলবে সেটা মশাই ষোল আনা নিশ্চিত। কিন্তু যদি জানতে চাওয়া হয়, অনিন্দ্য এই সুন্দরীর প্রেমে মজার কারণ কী, তাহলে কিন্তু অবস্থা দাঁড়াবে তথবৈচ। কারণ, রূপের মনোহরী এই রাণী কেবল যে তার লাস্যময়ী আবেদনের জন্য প্রেমিক হৃদয়ে হিন্দোল তুলে নিয়েছে তা নয়, বরং তার অনন্য খাদ্য বৈচিত্র্যেও মাতিয়েছে ভোজনরসিকদের হৃদয়। ভুরভুরে সুবাসে মাতোয়ারা শাহী মেজবানীর খানদানি স্বাদ থেকে শুরু করে চায়ের কাপে ঝড় তুলতে সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে চিটাগং কিং। কী করে? তাই জানাচ্ছি এখানে। বাকী সবার কথা তো বলা যাচ্ছে না, তবে এই মুহুর্তে লেখাটা যদি কোন চট্টগ্রামের বন্ধু পড়ছেন তো তিনি ঠিকই পাকড়ে নিয়েছেন আসল রহস্য। জ্বী, হ্যাঁ। বলছি, চিটগং এর ঐতিহ্যবাহী “বেলা বিস্কিট” র কথা। আর অবশ্যই সেটা “গণি বেকারী”র। মূল প্রসঙ্গে যাবার আগে বলতে চাই কিছু কথা। এই যে বিস্কিট নিয়ে এত জল্পনা কল্পনা, কেউ কী এই মুচমুচে টুকরোর নেপথ্য ইতিহাস জানেন? যারা জানেন না তাদের উদ্দেশ্যে দিতে চাই এই ক্ষুদে বার্তাটি।
চাটগাঁইয়ারা “বিস্কিট”কে বলে থাকেন “বিস্কুট”। “বিস্কিট” শব্দটি আমরা শিখেছি বৃটিশদের কাছ থেকে। “ফেঞ্চ” শব্দ “বিস্কিট” যেটা আসলে সখ্যতা গড়েছে ‘বিস’ ও ‘ককতাস’ নামে দুটি ল্যাতিন শব্দযোগে। যেটার ব্যবচ্ছদ করলে দাঁড়ায় “দুবার সেঁকা”। তার মানে, “বিস্কিট” হলো, “দুই বার সেঁকা জিনিষ”। তবে মশাই প্রাচীণ বিস্কিটের সন্ধানে বেরুলে যেতে হবে সূদূর ১৫৫৮ সালের “রোম সম্রাজ্যে”। বিস্তর যাত্রা বৈকি! এবার বলি, ভারতীয়রা এই বিচিত্র স্বাদের টুকরোর সন্ধান কী করে পেল? জানা যায়, মিশরীয় বণিকেরা শুকনো বিস্কিটের মত এক প্রকার রুটির সওদা করত। যাকে বলা হতো “ধউলা”। একই সময় সওদার পাল্লার দৌড়ে সামিল হয় রোমানরাও। তারা মূলত “বুচেলাম” নামের ময়দা দিয়ে শুকনো খাবার তৈরী করত। যেহেতু শুষ্ক খাবার, সংরক্ষণ করা সহজ, তাই দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রায় নাবিকেরা এই খাবারগুলো মজুত করে রাখত। তবে বিপত্তি বাঁধল এক জায়গায়। কেমন সেটা? দেখা গেলো, প্রথমে একবার সেঁকে নেওয়া জিনিষগুলো আদ্রতাতে তিন চারদিন পর নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেই বিড়ম্বনা এড়াতে তাই তারা পরে একে দুই তিনবার সেঁকে একদম শক্ত করে নেবার পরিকল্পনা করে। আর এভাবেই উৎপত্তি হয় “বিস্কিট” র। বলাবাহুল্য, পর্তুগীজ ও স্পেনিশরা যেহেতু সমুদ্রযাত্রায় এগিয়ে ছিল, তাই তারাই “বিস্কিট”র ব্যবহার করত বেশি। আর ভারতীয়রা বিস্কিট তৈরীর কলাকৌশল পর্তুগিজদের কাছ থেকে রপ্ত করেছিল আজ থেকে প্রায় তিনশ বছর আগে। এভাবেই উপমহাদেশে বিস্কিটের সম্রাজ্য বিস্তার লাভ করে। সেই সময়টাতে চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিবাজারে পর্তুগিজদের যাতায়ত ছিল আম ব্যাপার। সেজন্য বলা হয়, সেখান থেকেই আমাদের পূর্ব পুরুষেরা রপ্ত করে নিয়েছিল এই বিস্কিটের প্রস্তুতপ্রণালী।
ইতিহাসবিদদের মতে, আজ থেকে দুশ বছর আগে চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকার পাশে চন্দনপুরাতে আব্দুল গণি সওদাগর নামক একজন বণিক ছিলেন। ওনার পূর্ব পুরুষ লাল খাঁ সুবেদার ও ছেলে কানু খাঁ মিস্ত্রী প্রথম চট্টগ্রামে তথা উপমহাদেশে বেকারী পণ্যের সূচনা করেন। তবে এই বেলা বিস্কিটের জনক আব্দুল গণিকে বলা হয়। তিনি মূলত খাদ্যদ্রব্য সওদাপাতি করতেন। গণি বেকারী নামক তার নিজেরই একখানা দোকান ছিল। আব্দুল গণি পর্তুগিজ ও ইংরেজদের থেকে শেখা বিস্কিট বানানোর পদ্ধতির সাথে নিজের কিছু রেসিপি মিশিয়ে নিয়ে নতুন ধরনের এক বিস্কিট বানানোর কথা চিন্তা করলেন। যেই ভাবা, সেই কাজ। তিনি এই বিস্কিট টিনের পাতে করে ওভেনে সেঁকার বদলে মাটির পাতে তন্দুরীতে সেঁকার সিদ্ধান্ত নেন। আর তাতে ফল মিলল আশ্চর্যরকমের। এর অসাধারণ স্বাদের মাত্রা ছাড়িয়ে যায় পূর্বের সমস্ত রেকর্ড।
আব্দুল ফজলের রেখাচিত্র নামক বই থেকে জানা যায়, নেলায়েত আলী নামক একজন বিস্কিটের কারিগর এই সিস্টেমে বিস্কিট বানাতেন। অন্যান্য তথ্যানুযায়ী, এই বেলায়েত আলী সম্ভবত গণি বেকারীর প্রধাণ কারিগর। হতে পারে, এই আলাদা স্বাদের বিস্কিটের নাম হয়ত ছিল বেলায়েত আলীর বিস্কিট। যা সময়ের পরিক্রমায় “বেলা বিস্কিট” নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। তবে এমন তথ্যের কোন বাস্তব সত্যতা এখন অবধি মেলেনি। বেকারি শিল্পের প্রসারের কারণে ব্রিটিশ আমলেও চট্টগ্রামের মানুষের খাদ্যাভাসে বিস্কিট একটি আলাদা জায়গা করে নিয়েছিল। সকাল বিকালের চা চক্রের আয়োজনে বিস্কিটের সাহচার্য এত জনপ্রিয় হয়ে উঠে যে এর স্বাদের লহমা ছুঁয়ে দেয় গ্রাম গঞ্জের সীমানা রেখাকেও। গবেষক আহমেদ মমতাজের মতে, পর্তুগিজদের খাদ্যাভাসে ছিল রুটি, পাউরুটি, বিস্কিট সহ নানা ধরনের বেকারী পণ্য। তাদের মাধ্যমেই চট্টগ্রামে চট্টলাবাসীর খাদ্যাভাসে জড়িয়ে পড়ে বেকারির খাবার।
আরও জানা যায়, বেকারি শিল্পের প্রসার ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। তখন সৈনিকদের খাদ্য “গণি বেকারী” তেই প্রস্তুত করা হত। সেই সময় থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত ১৭টি বেকারীতে তৈরী করা হত বেলা বিস্কিট। তবে গণি বলা বিস্কিটের বিশেষত্ব হলো এর রন্ধন প্রক্রিয়া, যা আধুনিকতার ঢং এ পরিবেশিত না হয়ে এখনও এর পূর্বের ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে।
বেলা বিস্কিট আসলে চট্টগ্রামের খাদ্য ঐতিহ্য ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়। এর মুচমুচে স্বাদ যে কাউকে অনায়সে ধরাশায়ী করে নিতে সক্ষম। সাহিত্যেও মিলবে এর স্বাদের স্তুতি। কথাসাহিত্যিক আবুল ফজল ( ১৯০৩-১৯৮৩) ইতিহাসবিদ আব্দুল করিমের (১৯২৮-২০০৭) মতো মানুষদের স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে বেলা বিস্কিটের ইতিবৃত্ত কথা। চিটাগং এর মান এবং শান যদি মাপতে হয় তবে মেজবানের মতো বেলা বিস্কিটের স্বাদকেও সমীহ করতে হয় বৈকি। যার প্রমাণ, শতাব্দীর পর শতাব্দী পেড়িয়ে গেলেও চট্টলাবাসীদের বিকেলের নাস্তায় আজও শোভা পায় এই বেলা বিস্কিট। চট্টগ্রামের নগর ভবন থেকে শুরু করে বড় বড় অফিসে বেলা বিস্কিট আর চায়ের অফারে অতিথি আপ্যায়নের রেওয়াজ কিন্তু আজও বজায় রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, চায়ের কাপে বেলা বিস্কুট চুবিয়ে না খেলে চাঁটগাইয়াদের নাস্তার তৃপ্তি নাকি অপূর্ণ রয়ে যায়। আজব কথা। ভাববার মত বিষয় বটে! আরও বলি, কেবল চট্টগ্রামের সীমানার মাঝে নয় বেলা বিস্কিটের স্বাদের জয়জয়কার কিন্তু বিশ্বজুড়ে। তাইতো, প্রবাসীরাও তাদের থলেতে এই কুড়মুড়ে স্বাদের বাহার ভর্তি করে পাড়ি দেন তেপাম্তর। তবে? এই বেলা বিস্কিটের জাদুকরী কারিশমার বয়ান করবার আর খুব একটা বেশি আছে বলে তো মনে হয় না। তাই বলছি, আর বকবক না করে চটজলদি হাতে তুলে নিন চা আর বেলা বিস্কিটের জব্বর জুটি। এরপর নিজেই মিলিয়ে নিন। বাকী বিচারের ভার নাহয় আপনাদের ওপরেই ছেড়ে দিলাম। তাহলে? অযথা আর কেন সময় নষ্ট করা? কথায় বলে, “শুভস্য শীঘ্রম”। আমি তো ভায়া চললুম চা চক্রের মচমচে আয়োজনে ডুবতে। আর আপনি?
তথ্যসূত্রঃ পত্রপত্রিকা, ইন্টারনেট ও জার্নাল।