ভালোবাসার স্বীকারোক্তি

by soniatasnim

– আচ্ছা মা, তোমার কি কখনও ক্লান্তি লাগে না? রাখ তো, এসব ভ্যাজাল। আর ক’দিন পর চলে যাব। কোথায় একটু গল্প করব, না! তোমার এই সেই লেগেই আছে…

উত্তরে মা একটু হাসে। চুলার গনগনে হলুদ আগুনের আঁচের আলোতে বিপরীত দিকের সাদাটে দেওয়ালে মায়ের মতই তার ছায়াটাও কেমন ব্যস্ত ভঙ্গিতে কড়াইয়ের মাঝে খুন্তি নেড়ে চলছে। যেন রান্না প্রতিযোগিতায় আলো ছায়ার প্রতিযোগিতা চলছে। রান্না ঘরের হলুদাভ লাইটের আলোতে মায়ের গায়ে জড়ানো প্রিন্টের শাড়ীটা কেমন ম্যাটম্যাটে মলিন দেখায়। আবার রাগ উঠে যায় আমার। কী কী যে কাপড় মা পড়ে থাকে না!

– আচ্ছা মা, এসব কি শাড়ী পড়ে থাক বলত? কেমন রংচটা আর এই দেখ শাড়ীটা পড়েছ, তাও আবারউল্টো করে। আচ্ছা…

– দেখ তো বাবু, লবণটা ঠিক মত হয়েছে নাকি?

বাম হাতে চোখ থেকে নেমে আসা চশমার ডাঁটটা আবার জায়গামত বসাতে বসাতে মা ডান হাতে ধরা খুন্তিটা আমার দিকে এগিয়ে দেয়। খুন্তির চ্যাপ্টা মাথাতে থকথকে মসলা কসানির কিছু ছিঁটে-ফোঁটা অংশ লেগে রয়েছে। গজগজ করতে করতে হাত দিয়ে তা নিতে যাব তো তক্ষুণি মা আবার বলে

– সাবধানে বাবু, হাত মুখ পুড়বে দেখিস। গরম কিন্তু।

মায়ের দিকে আবারও তাকাই। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত এই মুখটা হাসি মাখানো। অবিশ্বাস্য প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এই চেহারার দিকে তাকালে মনটা কেমন আমার আপনা আপনি ভাল হয়ে যায়। আশ্চর্যের ব্যাপার, কখনই এই মুখটা ভার করা দেখি না। কখনও বলতেও শুনি না

– আর পারছি না রে, শরীরটা খারাপ লাগছে আজ।

মা আমার দিকে একই ভাবে তাকিয়ে এখনও। মুখের হাস্যোজ্জ্বল রেশটা এখনও রয়ে গেছে।

- কি রে, লবণ ঠিক আছে?

- হুম। আছে। হয়েছে তোমার? চলত এখন। একটু গল্প করি। কত কথা জমা হয়ে আছে।

- হ্যাঁ এই তো আসছি, চল।

মায়ের বুকে শুয়ে রয়েছি। মায়ের শরীর থেকে একটা কেমন মিষ্টি সুন্দর ঘ্রাণ আসছে। কি আশ্চর্য! মা ছাড়া কারো গায়ে কিন্তু এমন সুগন্ধ নেই। সব মায়েদের শরীরে কি এমন ঘ্রাণ থাকে? কি জানি? মাকে জড়িয়ে ধরে গল্প করতে থাকি। কতশত গল্প! ঝুলি যেন খালি হতেই চায় না। কথা বলি আর বলেই যাই। একসময় চোখের পাতায় পিড়ি পেতে বসে শান্তির ঘুম। ঘুমের অতলেও টের পাই মা সাবধানে পাশ বদল করে। শেষে আবার আমার ঘুম না ভাঙে। কখনও কপালে আঁকে আদর ছোঁয়া। ইদানিং মায়ের রান্নার ব্যস্ততা যে বহুগুণ বেড়েছে আরো। তার সেই ছোট্ট বাবু আজ বড় হয়েছে। পাড়ি জমাচ্ছে দূরদেশের পথে। যাবার দিন ঘনিয়ে আসে। মা আমার হাসি মাখা মুখে লাগেজ গুছিয়ে দেয় ঠিকযেমন ছেলেবেলায় পড়ার ব্যাগ গুছিয়ে দিত। মায়ের জন্য একদিন কতগুলো শাড়ী কিনে আনি। ওগুলো হাতে পেয়ে অশ্রুসজল কন্ঠে মা বলে

– অযথা বাজে খরচ করিস কেন? এখন তোর টাকার দরকার বাবু।

মাকে বলি

– চুপ করতো। এই হলুদ রংটা তোমাকে কত মানাবে দেখ। ওসব রংচটা শাড়ী ফেলে দিবে। আর পড়বে না।

চোখে টলটলে পানি নিয়ে মা বলে

- পাগল ছেলে

বিদায় ক্ষণেও মাকে কত ঝলমলে দেখাল। কিন্তু ওপরে যতই বাহাদুরি দেখাক, ভেতরে যে দুমরে মুচড়ে যাচ্ছে তা টের পেলাম শেষ ঘন্টার সময় যখন জড়িয়ে ধরে ধরা গলায় বলল

– সাবধানে থাকিস বাবু। ফোন দিস সবসময়।

মা টের পায় নি তখনও মায়ের গলার কেঁপে ওঠা স্বর আমি ঠিক ঠিক বুঝে নিয়েছিলাম। প্রথম প্রথম কী যে খারাপ লাগত, বলার না। কত রাত যে বাচ্চা ছেলের মত কেঁদেছি তার কোন ইয়ত্তা নেই। মায়ের সাথে ফোনে কথা বলার সময় থামতেই ইচ্ছে হত না। মনে হত সারাক্ষণ ফোনটা কানে ধরে রাখি। তারপর নতুন জগত, নতুন পরিবেশ, নতুন ব্যস্ততায় ভরা জীবনে কখন থেকে যেন একটু একটু করে যান্ত্রিক হতে থাকলাম। বাহিরের চাকচিক্য কেমন যেন নিজের থেকে নিজেকে অল্প অল্প করে দূরে সরিয়ে দিল। মাঝরাতে হঠাৎ হঠাৎ মায়ের ফোনে ঘুম ভেঙে গেলে বিরক্তই হতাম। ঘুম জড়ানো গলায় বলতাম

– এটা কোন সময় মা ফোন করার? সারাদিন বিশ্রাম পাই না। এমন এমন সময় ফোন কর যে ভয় লেগে যায়।

বুঝতে পারতাম না হয়ত ওপারে আশা জাগানো হাসি মাখানো মুখটা তখন কতটা মলিন হয়ে যেত। নরম কন্ঠটাই কেবল কানে আসত

– আচ্ছা বাবু। পরে সময় করে ফোন দিস।

ধীরে এই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের জগতেও নেমে আসে নাড়ীর টানের মাঝের এই দূরত্ব। আবেগের জায়গায় আগ্রাসনীভাবে গ্রাস করে নেয় নিষ্ঠুর বাস্তবতা। নাহ! নিজের দোষ ঢাকব না। স্বার্থপরতা। তা না হলে মায়ের নরম নিস্তেজ গলার স্বর, ইমো, ভাইবারের পর্দায় মলিন মুখটা কেমন করে আমার নজর এড়িয়ে গেল? নকল মোহে আমি এতটাই সন্মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম যে আমার মাঝের আমিতেই ছিলাম না। ঘোর কাটতে যে আমার অনেকটাই দেরী হয়ে গেল।

– বাবু, আসছে শীতে দেশে আসবি বলেছিলি। কবে আসবি?

- না। মা। বলেছিলাম ঠিক। তবে এখন পারব না। কিছু সমস্যা আছে। দেখি পরে কোন সময়…

ভাবি, এত তাড়ার কি আছে? আরো তো সময় আছে। অযথা এত জলদি বাড়তি খরচ। ওপারে মলিন স্বর শোনা যায়

– ওহ! আচ্ছা। তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল। শরীরটা ভাল যাচ্ছে না তো…

– একটু নিজের খেয়াল রাখ মা।

“হুম,” খেয়াল রাখার কথা বলে তো দিলাম অথচ নিজে খেয়াল করলাম না আজ মনে হয় মাকে স্বীকার করতে শুনলাম যে মায়ের শরীরটা ঠিক নেই। আসলেই খেয়াল করি নি? নাকি কথাটা খেয়ালেই নেইনি? দিন যায়। বেশ আছি এখানে। জীবনটা আপন খেয়ালে চলছে।”রাত করে বাড়ি ফিরিস না,” “দিনে দিনে হ্যাংলা হচ্ছিস”, “বেশি তেল চর্বি খাস না”এত উপদেশ আর নিয়মের মাঝে নিজেকে অন্তত আর সেই স্কুল বালক বলে মনে হয় না। স্বাধীনতা বেশ উপভোগ করে নিচ্ছিলাম। অত:পর একদিন ছন্দ পতন। কদিন ধরে দেশের কোন খোঁজ খবর নেই। আচমকা একদিন খবর এল। সেদিন বাড়ি ফিরে স্ন্যাকস হাতে নিয়ে মুভি দেখব বলে বসেছি। একের পর এক কল আসছিল দেশ থেকে। ভাবলাম, মুভিটা শেষ করে কল ব্যাক করি। সময় নিয়ে তখন কথা বলা যাবে। করলাম ও তাই। তবে যা শুনলাম, তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না একদমও। মা নেই! দু টি কথা। কিন্তু জীবনটা যেন উলট পালট করে দিল। তাহলে এই খবরের জন্য এতক্ষণ ফোন আসছিল? আর আমি! মায়ের মুখটা ভেসে উঠে সামনে। আচ্ছা, শেষ সময়ে কি আমার মায়ের খুব কষ্ট হচ্ছিল? মা কি আমাকে তখন খুঁজেছিল? খুঁজবেই তো! মা কি আমার সত্যিই আর নেই? কিন্তু একি! বুকের মাঝে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে কিন্তু চোখ দুটো পাথর হয়ে গেল কেন? তবে কি আমার চোখের জল শুকিয়ে গেছে? ভেবেছিলাম, এবার দেশে যাব না। কিন্তু ভাবলে কি হয়? মা যে আমাকে দেখতে চেয়েছিল। উড়াল দিয়ে নীড়ে ফিরি। সব আছে। মা নেই। শূণ্য বাড়ি খাঁ খাঁ করছে। ভেসে আসছে আতর লোবানের গন্ধ। হিমঘরে যখন মায়ের মুখটা দেখি, তখনও কি আশ্চর্য! মায়ের মুখটা সেই রকমই হাসি হাসি। কাঁপা হাতে মায়ের মুখটা স্পর্শ করি। কেমন ঠান্ডা! ভেজা, ভেজা। আমার স্পর্শ যেন মা বুঝতে পারল

– এসেছিস বাবু, বাঁচালি। কি ঠান্ডা! শীতে জমে যাচ্ছি। এখান থেকে আমাকে নিয়ে যা বাবা।

– কষ্ট হচ্ছে মা?

উত্তরে মায়ের মুখটা যেন আরো প্রশান্ত হলো।

শেষ ঠিকানায় মাকে নামানোর পর কেমন যেন হয়ে গেলাম। এত নিরালায় সারিসারি মাটির ঘরের নির্জনতার মাঝে মাকে একা ফেলে আসতে আমার একদমও সাহস হচ্ছে না। এত সাহস হচ্ছে না আমার। কিছুতেই হচ্ছে না। মায়ের কবরটা বুকে আঁকড়ে ধরি। বুকটা ভেঙে যাচ্ছে। পাগলের মত মায়ের শরীরের সেই ঘ্রাণটা খুঁজতে থাকি। কিন্তু পাই না। বদলে নাকে এসে লাগে সদ্য খুড়াখুড়ি করা কাঁচা মাটির সোঁদা গন্ধ। হঠাৎ আবিষ্কার করি আমার দু চোখে বর্ষা নেমেছে। আমি কাঁদছি। উন্মাদের মত কাঁদছি। আমি সত্যি সত্যি আবার কাঁদতে পারছি।

মা, মাগো, কত কথা বলার ছিল মা তোমাকে। কিছুই বলা হয় নি। বুকের মাঝে তোমার ক্লান্ত মাথাটা নিয়ে কখনও বুঝি বলাই হয় নি “তোমাকে কত ভালবাসি।”একবার সেটা বলার সুযোগ করে দাও মা।প্রতি বছর তোমার কোলে ফিরে আসব কথা দিচ্ছি। তুমি না চাইলে অন্য কোথাও পা ও ফেলব না। মা, তুমি…

কোন যুক্তি আর আমার মাঝে কাজ করছে না। চোখের পানি আমার বাঁধ ভাঙছে না। নীরব কবরস্থানের শান্ত বাতাস ভারী হয়ে উঠছে কান্নায়। আচমকা বাতাসের পালকিতে মায়ের কথা যেন কানে ভেসে আসে আমার

– এত কাঁদিস না বাবু। বেশি কাঁদলে যে তোর মাথায় যন্ত্রণা হবে।

আমি সহ্য করতে পারি না। চিৎকার করে কেঁদে বলি

– মা… তোমাকে অনেক ভালোবাসি মা।

Related Posts

Leave a Comment