দুই মালাটের মাঝে বন্দী কতগুলো শ্বেত শুভ্র পাতা, অনন্য তাদের ঘ্রাণ। নতুন পাতার ঘ্রাণে উদ্বেলিত হয়ে, ওতে সজ্জিত কীটের মত কিলবিল করতে থাকা কালো অক্ষরগুলোর মোহনীয় জাদুর মাঝে হারিয়ে যায় না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর। বন্ধ ঐ মালাইকাটের ঝাঁপি উন্মোচন করতেই কখনও আমরা হারিয়ে যাই দূর ইতিহাসের অতলায়ন্ত গর্ভে, কখনও প্রেম আর আবেগে হই আবেগতাড়িত, কখনও রহস্য সমাধানের নেশায় হই রোমাঞ্চিত, কখনও বা হারাই ছন্দের জাদুকরী শৈলীর মাঝে, কখনও যুক্তি তর্কের উদ্দীপনা জাগে মস্তিষ্কেপ নিউরনে, আবার তেমনি কখনও বা অশান্ত মনে জাগে প্রশান্তির পরশ, তো পরমুহূর্তেই আবার নব আবিষ্কারের নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ি অনায়সেই।
আসলে, বই এমনই একটা আপেক্ষক, যা কিনা ক্ষণিকের মাঝেই আমাদের বিচরণ করিয়ে নিতে সক্ষম হয় অন্য কোন ভূবনে, জীবনের চেনা গল্পের রূপ রসগুলোকে আবারও পরিচয় করিয়ে দেয় নতুন ভাবে। কল্পলোকের জাদুর গালিচাতে সওয়ার হয়ে নিমিষেই আস্বাদন করে নেই আমরা কল্পলোকের স্বাদ, তেমনি উপন্যাসের বিন্যস্ত পাতায় পরম যত্নে সেঁটে থাকা কোন ঘটনা কোন গল্প পড়ে নেবার পর মনে এমন অনুভূতি জেগে ওঠে যে, “আরে! এ যে আমারই গল্প! আমারই কথা!” আর ঠিক তাই বুঝি রাজা স্টিফেন বলেছিলেন
“বই একটি সহজে বহনীয় জাদু।”
একথা দ্ব্যর্থহীন ভাবে স্বীকার্য, যে, নি:সন্দেহে বই মানুষের সবচাইতে বড় সঙ্গী। একাকীত্বের ভারে যখন মাঝে মাঝে নুয়ে পড়ে জীবন, সেই সময় এই বই সাহচার্য দেয় একজন প্রকৃত বন্ধুর মত। নিজের জ্ঞান ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে, ক্ষীণ স্রোতস্বীনীর মত নিজের মজে যাওয়া আত্মবিশ্বাসকে পুনরায় কলতান মুখর করে তুলতে, নিজের মনের কথাগুলো প্রকাশ ঘটাবার জন্য অনিন্দ্য শব্দমালার সম্ভার বাড়িয়ে নিতে বই এর কোন বিকল্পই হয় না। সেই কারণেই বলা হয়, বই একজন মানুষের সত্যিকার অর্থে প্রকৃত বন্ধু। এ প্রসঙ্গে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বিখ্যাত উক্তিটি না বললেই নয়
“বই এর মত এত বিশ্বস্ত বন্ধু আর নেই।”
আর আজ ২৩শে এপ্রিল জীবনের এই প্রকৃত বন্ধুর প্রতি ভালবাসার প্রকাশ ঘটাতেই জন্ম হয়েছে বিশ্ব বই দিবসের। কি করে অংকুরিত হল এমন অসাধারণ এক দিবসের? একটু জেনে নেই সেই বিষয়ে।
বিশ্ব বই দিবসের প্রকৃত ধারণা প্রদান করেন স্পেনের লেখক ভিসেও ক্লাভেল আন্দ্রেস। জানা যায়, ১৬১৬ সালের এই ২৩ শে এপ্রিল আন্দ্রেসের প্রিয় এবং স্পেনের আরেকজন বিখ্যাত লেখক মিগেল দ্য সেভার্ত্তেম দেহ ত্যাগ করেন। আন্দ্রেস ছিলেন তার ভাব শিষ্য। স্বভাবতই, গুরুর মহা প্রয়ান তাঁকে চরম ভাবে ব্যথিত করে। তবে সেই শোককে শক্তিতে পরিণত করে, প্রয়াত গুরুর প্রতি ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা জানাতে আন্দ্রেস এক অভিনব পন্থার উদ্ভব ঘটান। ১৯২৩ সালের এই ২৩ শে এপ্রিল থেকে আন্দ্রেস স্পেনে পালন করতে শুরু করেন ‘বিশ্ব বই দিবস’ এর এবং সেই সঙ্গে এটিকে একটি প্রথাতে পরিণত করতে জোর দাবী জানান। তবে এটি তখন তেমন কোন সাড়া ফেলতে পারে নি। পরবর্তীতে, ১৯৯৫ সালে “ইউনেস্কো” কতৃক এই দিনটিকে বিশ্ব বই দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদাণ করা হয়। সেই থেকে প্রতি বছর যথাযথ মর্যাদা আর ভালবাসা দিয়ে উদযাপিত হয় এই প্রাণের দিবসটি। বই প্রেমীরা বই এর প্রতি তাদের অপরিসীম অনুরাগের অনুরনে মাতিয়ে তোলে এই দিনটি।
মূলত, এই বিশ্ব বই দিবসের মূল উদ্দেশ্য হল বই পড়া, বই ছাপানো, বই এর কপিরাইট সংরক্ষণ সম্পর্কিত সচেতনতা বাড়ানো। তাই আজকের এই মহা লগ্ন বিশ্বের সমস্ত লেখক, পাঠক, প্রকাশক, সম্পাদকদের মাঝে নীরবে গড়ে ওঠে এক অদৃশ্য সেতুবন্ধন এবং অবশ্যই বই এর সঙ্গে আত্মার বন্ধনকে করে তোলে আরও সুদৃঢ় এবং মজবুত।
আরও একটা বিষয় না বললেই নয়, ২৩ শে এপ্রিল শুধু মাত্র বই দিবসের জন্য নয় এর মাহাত্ম কিন্তু আরও বিস্তৃত। জগত বিখ্যাত সাহিত্যিক এবং লেখক উইলিয়াম শেক্সপিয়র, সত্যজিৎ রায়, ইনকা গার্সিলাথো ডে লা ভেগা সহ প্রমুখ খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের মাঝে কেউ বা এই দিবসে পৃথিবী আলোকিত করে জন্মেছেন আবার কেউ বা আমাদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে সাহিত্যাকাশে তারা হয়ে গেঁথে গিয়েছেন চিরতরে। তাই সহজেই অনুমেয়, বই এবং বই এর সাথে সম্পর্কিত এসব অসংখ্য মেধাবী নক্ষত্ররাজির সংযোগ বিয়োগের ইতিহাস এই দিবসটিকে এক অনন্য মাত্রাতে অধিষ্ঠিত করেছে।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট, পত্রপত্রিকা, বই পুস্তক