– এবার দেখবে, ঠিক ঠিক ছেলে হবে।
কোমল কিন্তু দৃঢ় স্বরে কথাটা বলে সৌমুলি। ওর হাতে ধরে নেওয়া উলের কাঁটা দুটো বিরামহীন ভাবে ওপর নিচ করে ওঠা নামা করছে। অতুনু ল্যাপটপে বসে অফিসের কাজ করছিল একমনে। আগামী পরশু একটা ইম্পরট্যান্ট অ্যাসাইনমেন্ট সাবমিট করবার কথা। কাজের প্রচুর প্রেশার যাচ্ছে ইদানিং। সৌমুলির এখন অ্যাডভান্স স্টেইজ। তাই যতদূর সম্ভব ঘরে থাকবার চেষ্টা করে অতুনু। কে জানে কখন পরিস্থিতি কি হয়? দু ঠোঁটের মাঝে কলম চেপে রেখেছে অতুনু। বাবা হবার সুখবরটা যেদিন ও প্রথম পায় সেই দিন থেকে পণ করেছিল সন্তানের প্রতি প্রথম কর্তব্য হিসেবে এবার স্মোকিং এর ইতিটা ও টেনেই নেবে। তারপরও দু একবার যে ভুল করে ফেলে নি তা নয় তবে ধীরে এখন সেটা সমঝে এসেছে। ঐ মাঝে মাঝে খেয়াল চাপলে কলমটাকে দু ঠোঁটের মাঝে চেপে নেয় কিছুক্ষনের জন্য। সৌমুলি তো ওর এই ব্যবস্থা দেখে হাসতে হাসতে একাকার হয়। বলে
– সে কি! কোথায় বাবুন কলম পেন্সিল চাবিয়ে নেবে মাড়ি শক্ত করে নিতে তা না তুমি তো বাপু…
এতটুকু বলেই সৌমুলি হাসতে থাকে খিলখিলিয়ে। কি সুন্দর ওর হাসিটা! মনে হয় যেন জল তরঙ্গে মৃদু লয় জেগে উঠেছে। অতুনুর ভীষণ ভাল লাগে সৌমুলির এই উচ্ছ্বল্যতাকে। ইস! ওদের অনাগত সন্তানের হাসিটাও যদি সৌমুলির হাসির মত হত! অতুনুর খুব ইচ্ছে, ওদের এবারও আরও একটি মেয়ে হোক। আর সে দেখতে হবে অবিকল সৌমুলির মত। মায়া ভরা হাসি খুশি মিষ্টি একটা মুখ। যে তার আধো আধো বুলিতে বাবা বাবা বলে ডেকে অতুনুর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু সৌমুলির কি রোখ চেপেছে এবার ওর ছেলেই চাই। কি ছেলেমানুষি! ওর বাড়াবাড়িতে কাল সনোগ্রাফি করবার সময়ও অতুনু জানতে চায় নি সন্তান ছেলে না মেয়ে হবে? তাতে কি রাগটাই না করেছে সৌমুলি! গতকাল থেকে এখন পর্যন্ত গোটা একদিন তো কথা অবধি বলে নি পর্যন্ত অতুনুর সঙ্গে। সৌমুলির অকস্মাৎ কথা বলাতে এবারে একটু সহজ হয় অতুনু। কোলের ওপর থেকে ল্যাপটপটা নামিয়ে নেয় আস্তে করে। পা টিপে টিপে ওর কাছে গিয়ে বসে। সৌমুলি চোখ তুলে তাকায় না ওর দিকে। ও নিবিষ্ট হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ওর ঘন কুন্তলে হাত বুলিয়ে নিতে নিতে অতুনু বলে
– আচ্ছা পাগলি তো তুমি! এ কেমন পাগলামি বল তো তোমার?
– তুমি জানতে দিলে না কেন?
সৌমুলি আরেকপাশ ফিরে কথাটা বললে হেসে ফেলে অতুনু।
– ওহ! এই কথা! থাকুক না কিছু ব্যাপার অজানা। পরে রহস্য উন্মোচনের মজাটা পাওয়া যাবে বেশ!
– কিসের রহস্য! যতোসব। আমি কোথায় চিন্তায় আছি যে ছেলে হবে না মেয়ে হবে…
সৌমুলির প্রতিক্রিয়াতে অবাক এবং বিরক্ত দুইই হয় অতুনু। তবুও যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক ভাবে বলে
– ছেলে হলেও আমাদের, মেয়ে হলেও আমাদের মৌলি। তুমি কেন এটা নিয়ে এত হাইপার হচ্ছ?
– ধূর! তোমাকে বুঝানো যাবে না। সর…
সৌমুলি ফের কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। কাঁচা মিঠে আমের মত দুপুরের কড়া রোদের আলো জানালা গলে ঘরে প্রবেশ করেছে। সেই রোদের কিরণচ্ছটা তার আদর বুলিয়ে দিচ্ছে সৌমুলির গালের এক পাশে। তা দেখে বড় ঈর্ষা জাগে অতুনুর। এত নিবিড় করে ও কি কখনো সৌমুলির ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছে? ধ্যাত! কি সব ভাবছে ও এসব আবোল তাবোল। নিজের ভাবনায় নিজেই হেসে ওঠে ও। ইতিমধ্যে সোয়েটারের কলার বুনে নিয়েছে সৌমুলি। ডিমের কুসুমের মত মিষ্টি হলদে রঙ। বিছানার ওপর ওটাকে বিছিয়ে নিয়ে একমনে দেখছে সৌমুলি। ওর চিকুর দাঁতের মাঝে ধরে রেখেছে কমলা উলের সুতো। অতুনু আবারও মুগ্ধ হয়।
– ধূর! ঠিক হলো না মনে হয়।
আবারও বিরক্তির ছাপ জাগে সৌমুলির আদুরে চেহারাতে। ইদানিং সৌমুলি দেখতে আরও মিষ্টি হয়েছে। সবাই তো বলে মেয়ে সন্তান হবার সময়ে নাকি মায়েরা দোখতে আরও সুন্দরী হয়। স্নিগ্ধার সময়ও অবশ্য সৌমুলি এমনটাই মোহনীয় হয়েছিল। তবে কি এইবারও…মনে মনে পুলকিত হয় অতুনু। সৌমুলির দিকে আড় চোখে তাকায় ও আবারও।
– ধ্যাত!
সৌমুলি ওর হাতে থাকা উলের কাঁটা নামিয়ে নিয়েছে। সেই দিক দেখে নিয়ে অতুনু বলে
– কেন, কি হয়েছে?
– দেখ না। জেন্টস কালার তো ব্লু হয়। তাই না? আমি এখানে…
– হুম। তো সমস্যা কোথায়? হলুদ কমলা এসব তো ছেলে বা মেয়ে যে কোন জনই গায়ে দিতে পারে। তাই না?
– নাহ! আমার ছেলেই চাইই। কোন কনফিউশান রাখতে চাই না আমি। মেয়ে দিয়ে কি হবে বল তো?
– হুমমমম। তা বটে! আমিও মাঝে মাঝে ভাবি সেটা। মেয়ে দিয়ে কি হবে? বল! এই যে তোমাকেই দেখ আগের একটা বাচ্চা সামাল দিতে কত হিমশিম খাচ্ছ। এর মাঝে আরেকজন। জবটা এবারে কন্টিনিউ করতে পারবে কি না সন্দেহ। বুয়াটাও নেই। আমার অফিস আছে। সব সময় তো এমন সময় দিতে পারব না তোমাকে। বাচ্চাদের টেক কেয়ার করা, বাড়ি দেখাশোনা করা, সংসার সামলানো কি করে হবে এসব তোমায় দিয়ে…
– মানে কি, কি বলতে চাও তুমি? আমি জব আর সংসার সামলাতে পারব না? এত কমজোর মনে কর তুমি আমাকে? স্নিগ্ধার সময় আমি কি…
সৌমুলির উত্তেজিত কথার মাঝে অতুনু বলে ওঠে
– সেটা নয়। মানে বলতে চাচ্ছিলাম…
– কি বলতে চাচ্ছিলে তবে…
ঝেঁঝেঁ উঠে সৌমুলি বলে
– এটাই তো বুঝাতে চাচ্ছ না যে, পুরুষ ছাড়া একজন নারী অক্ষম। মেয়েরা আসলে কোন কিছুই নিজে করতে পারে না তাই না? এত সহজ নয় বুঝলে…তোমার নিজের মা কেই দেখ না, তোমাদের পাঁচ ভাই বোনকে তো তিনি একাই সামলে নিয়েছেন। এই বয়সেও ভিটে বাড়ি একাই সামাল দিচ্ছেন, উল্টো এলাকার মহিলাদের হয়ে কত রকম কাজ করে যাচ্ছেন…
– তা ঠিক। তবুও…
– তবুও মানে? শোন, অতুনু, মেয়েদের এতটা ছোট করে দেখ না। নারী শক্তি সম্পর্কে আসলে তোমাদের কোন ধারণাই নেই বুঝলে! ভাল ভাবে গড়ে উঠলে একটা মেয়েই দশটা ছেলের সমকক্ষ বুঝলে?
সৌমুলির কথাতে এবারে হো হো করে হেসে ফেলে অতুনু। ঝটপট নিজের মাথাটা সৌমুলির কোলে রেখে ওর চিবুক ছুঁয়ে নেয় আলতো করে। আর হাসি মুখে বলে
– এই তো আসল কথাতে এলে!
– মানে?
সৌমুলির বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে অতুনু বলে যায়
– মানে, আমিও তো তাই বলি। একটি যোগ্য মেয়ে দশটি ছেলের সমতূল্য। এই কথাটা মনে মনে বিশ্বাস করলেও তুমি মুখে কেন আনতে চাও না, বল তো?
– তুমি আমার সঙ্গে ট্রিক্স করেছ তবে?
সৌমুলি ভীষণ লজ্জা পেয়ে বলে।
– জ্বী, ম্যাডাম। একদম।
গম্ভীর হয়ে কথাটা বলে অতুনু।
– তুমি তো খুব…
সৌমুলি কথা শেষ না করতেই অতুনু ওর হাতটা ধরে নেয়। ওর স্বপ্নীল আঙুলগুলো নিয়ে খেলতে খেলতে বলে
– আমি বিশ্বাস করি, নারী শক্তি হয় অতল স্পর্শী। তবে এটাকে সবার আগে তোমাদের বিশ্বাস করাটা প্রয়োজন। ভেবে দেখ, তোমরা নারী হয়ে যদি নিজেদের স্বীকৃতি দিতে নিজেরাই এত দ্বিধা কর তবে গোটা পৃথিবীর দোষ দেওয়াটা কি আসলে যুক্তিযুক্ত হয় বল? বোকা মেয়ে, প্রথমে নিজেদের মর্যাদা দিতে শিখ। নিজের অস্তিত্বে গর্ব করতে শিখ। তবেই না নারী তার যোগ্য সম্মান পাবে যা কিনা তার প্রাপ্য। একজন নারী হয়ে নারীত্বের এমন অপমান করো না সৌমুলি। তাতে করে তুমি নিজেই যে ছোট হয়ে যাবে।
– কিন্তু সবাই যে বলে…
– সবার ভাবনাটাই সব নয় মৌলি। আর তোমার ভাবনাটা! বল, ওটার কি হবে? এমন করেই কি তবে সব সময় নিজেদের কন্ঠকে গলা টিপে হত্যা করবে? সবাই কি বলল না বলল সেটা না হয় একপাশে সরিয়ে নেই। কেন বুঝতে পার না, এই নষ্ট সমাজের এটাই তো মোক্ষম অস্ত্র নারীদের পদদলিত করে রাখবার জন্য।
সৌমুলি চুপ করে রয়। ওর মুখের ওপর রৌদ্র ছায়া খেলে বেড়াচ্ছে এখনও। চোখের তারায় জেগেছে কেমন এক ঔজ্জ্বল্য। ওর কপালের ওপর নেমে আসা দু একটি চুল হাতে সরিয়ে নিতে নিতে অতুনু বলে
– কি ভাবছ?
– একটা কথা বলব তোমাকে?
– হ্যাঁ। বল না!
– বলছিলাম, এবারে আমাদের মেয়ে হলে ওর নাম রাখব “জয়িতা”। কেমন হবে বল?
সৌমুলির সপ্রতিভ কথায় শিহরিত হয় অতুনু। ওর কোমল হাতটাকে জড়িয়ে ধরে গভীর আবেগে। অতুনুর চোখে মুখে জেগেছে অন্য এক আবেশ। জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আম গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে সূর্য কিরণ নেচে বেড়াচ্ছে। পত্র পল্লবের মাঝে মৃদু বাতাসে অনুরণ জাগছে ঝিরঝির। সেই সবের মাঝে নিজেকে সঁপে দিতে দিতে ধরা গলায় অতুনু বলে
– হ্যাঁ। সৌমুলি। তুমি ঠিক বলেছ। ওর নাম হবে “জয়িতা”। আমাদের “জয়িতা”।